‘বাবা’ একটি অবলম্বন
বাবা দুটি অক্ষর বেষ্টিত ছোট্ট একটি শব্দ। ‘বাবা’ একটি নির্ভরতা, একটি আশ্রয়, একটি স্বপ্ন, একটি পৃথিবী। একজন বাবা সন্তানের কাছে প্রিয়, কারো কাছে অপ্রিয় আবার কোনো সন্তানের সাবলম্বী সময়ে হয়ে ওঠে বোঝা।
আজ বাবা দিবস। ১৯০৮ সাল থেকে শুরু হয় বাবা দিবস উদযাপন। বছরের জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পালিত এই এই দিনটি। অবশ্য কিছু দেশে ভিন্ন দিনেও পালিত হয়। কোথাও বাবা ছেলেদের দৌড় প্রতিযোগিতা, কোথাও বাবাদের হাইকিং আবার কোথাও ক্যাথলিক উৎসব উদযাপন করা হয়। বাবারা সমাজে অনেকটাই অবহেলিত। সামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশক্ষেত্রে পরিবারের উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম বাবা। পরিবারের ভরন—পোষন, স্ত্রী—সন্তানের সখ—আহ্লাদসহ সব চাহিদা পূরণ হয় এই মানুষটির পরিশ্রমে। অথচ তারা যথাযথ মূল্যায়ন কখনোই পাননা।
একজন সন্তানের প্রিয় মানুষের কথা উঠলেই প্রথমে ’মা’ শব্দটি আসে। মাকে নিয়ে লিখতে গেলে যতটা আবেগ আর কোমলতা প্রকাশ পায়, বাবাকে নিয়ে সেটুকু বলা একটু কঠিনই যেন। অথচ নিজের জীবনের সখ—আহ্লাদ বিলিন করে সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যস্ত এই বাবা। এমন স্বার্থহীন বাবার জন্য পৃথিবীতে একটা দিবস থাকা নিশ্চয় গুরুত্বহীন ও অপ্রয়োজনীয় নয়।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্যাটেলাইটের সুবাদে বাবা দিবস ঘটা করেই পালিত হয়। কিন্তু তার ফলাফল শুণ্য। আজকের এই বাবা দিবসেও অসংখ্য বাবা অনাহারে রয়েছেন, অন্যের দুয়ারে হাত পাতছেন, সন্তানের ভয়ে ছোট্ট ঘরে বন্দি হয়ে আছেন নয়তো বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। আর সেই বাবারই সন্তান হয়তো ঘুরছেন সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে কোনো পার্কে, বসবাস করছেন সাজানো দালানে, খাচ্ছেন কোনো নামী রেস্টুরেন্টে। হয়তো সেই সন্তানই বাবার পক্ষে গান, আবৃত্তি, বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করে ফেলছেন। নচিকেতার ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার’ গানটি কারো অচেনা নয়। সমাজের বাস্তবতাও পুরোপুরি ভিন্ন নয়। সন্তানের জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করা বাবার ঠাঁই হয়না সেই সন্তানের সুখের সংসারে।
আমরা সবসময় দোষারোপ করি সন্তানদের। আসলেই শুধু সন্তানরাই কি দায়ী এসবের পিছনে? না, সবক্ষেত্রে নয়। অবহেলিত বাবারা নিজেরাও দায়ী অনেক সময় এমন পরিস্থিতির জন্য। হয়তো সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে না পারার কারণেও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় অনেক বাবাদের। সত্যিকারের বাবা তো তিনিই, যিনি সন্তানকে বাঁচতে শেখান, ভুল ও সঠিক যিনি আলাদা করতে শেখান। গভীর থেকে ভালবাসেন সন্তানকে। প্রচলিত একটি মন্তব্য পাওয়া যায়, ’প্রতিটি বাবাই নিজ সন্তানকে যথেষ্ট ভালোবাসে’। সমস্যার সৃষ্টি এখানেই। ভালবাসাকে আমরা টাকা দিয়ে বিচার করি সবখানে। শুধু টাকা খরচ করে কখনো সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন টাকার পাশাপাশি সন্তানকে যথেষ্ঠ সময় দেওয়া, সন্তানকে বুঝতে পারা, সন্তানের স্বপ্ন ও চাহিদার গবেষণা করা।
অধিকাংশ বাবার ব্যর্থতা এখানেই। ছোট বাচ্চা যখন পিতার প্রকৃত ভালবাসা থেকে বিরত হয়, তখনই সন্তানের সঠিক পথ বন্ধ হয়, একটি খারাপ সংঘের সাথে মেলামেশা করে, পড়াশোনা নষ্ট হয়, অন্ধকার হয় তার ভবিষ্যত। এজন্য প্রয়োজন সন্তানের জবাবদিহিতা ও সন্তানকে যথেষ্ঠ সময় দেওয়া। একটি কথা মনে রাখতে হবে, ‘এখন সময় আধুনিক। একজন বাবা হয়তো পুরোনো প্রথায় বিশ্বাসী। সেই প্রথা হয়তো আধুনিক সময়ের সাথে সাংঘর্ষিক হতেই পারে। এক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে আধুনিকতার ছোঁয়ায়, ত্যাগ করতে হবে একরোখা মানসিকতা। প্রয়োজন যথাসম্ভব বাচ্চাদের সাথে সময় ব্যয় করা।’ তাহলেই হয়তো আপনার যত্নশীলতা ও সন্তানের পথচলার মিলন ঘটবে। শিশু, তার বাসনা এবং জীবনের অবস্থানকে সম্মান করা উচিত প্রত্যেক বাবার। সন্তানের প্রিয় বন্ধু হয়ে তার সাথে গল্প করা, ভ্রমণে বের হওয়া, তার ভাললাগা—মন্দলাগা বিষয়গুলো জেনে সমাধান করা উচিত বাবাদের।
মনে রাখা জরুরী প্রত্যেক বাবাই তার সন্তানের কাছে আইডল। বাবার আদর্শ, আচরণ, কর্মকাণ্ড প্রভাবিত করে সন্তানের ভবিষ্যৎ। বাবার উপার্জন কৌশল, পেশাদারিত্ব, দায়বদ্ধতা, সহনশীলতা, বাচনভঙ্গি, উদাসীনতা, সমাজিকতা, সুখ—দুঃখ খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায় সন্তান। সেখান থেকেই প্রাথমিক জীবন গড়তে শেখে সে। প্রতিটি দিবস কেন্দ্রিক অসংখ্য লেখালেখি হয়, কিন্তু ফলোআপ? নেই। লেখালেখিতেই আমরা সীমাবদ্ধ। নেই সংস্কারের উদ্যোগ। প্রতিটি বাবা হোক সুখি, সন্তানরা হোক বাবাপ্রেমি। বৃদ্ধাশ্রমগুলো হোক সাবলম্বী সন্তানদের বাবা—মা শুণ্য। চলুন আজকের বাবা দিবস থেকেই শুরু করি নতুন কোনো ধারায় বাবাকে ভালবাসা। বিশ্বের সকল বাবার প্রতি রইল শ্রদ্ধা।