fbpx
হোম ক্রীড়া প্রথমবার সেন্ট মার্টিনে, তা–ও সাঁতার কেটে
প্রথমবার সেন্ট মার্টিনে, তা–ও সাঁতার কেটে

প্রথমবার সেন্ট মার্টিনে, তা–ও সাঁতার কেটে

0

২০১৯ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটি। সেখানেই একদিন (বাংলা চ্যানেলজয়ী সাঁতারু সাইফুল ইসলাম) রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তাঁর কাছেই চ্যানেল সম্পর্কে প্রথম সবক পেলাম। তারপর নিজেও তৈরি হতে শুরু করি। কিন্তু ২০২০–২১ সালে করোনার কারণে অভিযানে যাওয়া হলো না। ২০২২ সালে সব প্রস্তুতি নিয়েও পায়ের আঘাতের কারণে পরিকল্পনা বাতিল করতে হলো। ২০২৩–এ ‘১৮তম বাংলা চ্যানেল সাঁতার’-এ অংশ নেওয়ার সুযোগ তাই কোনোভাবেই হারাতে চাইছিলাম না। আমার প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এগিয়ে আসায় কাজটা আরও সহজ হলো।
আমি এমনিতেই ধীরগতির সাঁতারু। রোজ পুলে সাঁতার কেটেও তাই মন ভরছিল না। তা ছাড়া খোলা পানিতে কোনো দিন সাঁতারও কাটিনি। শুধু ‘বদ্ধ’ অভিজ্ঞতা নিয়ে বঙ্গোপসাগরে সাঁতার কাটতে যাওয়াটা উচিত হবে না। তাই পুকুরে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। তত দিনে ঢাকাতেও শীত পড়তে শুরু করেছে। তবু সকাল সাড়ে ছয়টা কি সাতটার মধ্যে জহুরুল হক হলের পুকুরে নেমে পড়ি। দুই থেকে তিন ঘণ্টা টানা সাঁতার কাটি। এভাবে অনুশীলন করতে করতেই ডিসেম্বর চলে আসে। সময় যত ঘনিয়ে আসে, তত বাড়তে থাকে চিন্তা। স্কুলের গণিত পরীক্ষার আগের রাতের মতো মনে ভয় ভর করতে থাকে।
ভারতের এসব সমুদ্রসৈকতে গিয়ে কেন কক্সবাজারের জন্য মন খারাপ হলো
প্রিয় মানুষদের দেওয়া সাহসকে পুঁজি করে ২৫ ডিসেম্বর টেকনাফের বাসে উঠে বসি। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যাওয়ার সময় সমুদ্রের ঢেউ দেখে মনে সংশয় উঁকি দিল, পারব তো!
সেদিনই সবার সঙ্গে অনুশীলন করতে টেকনাফের সৈকতে গেলাম। পাড়ে বসে বিশাল ঢেউ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই উন্মাতাল ঢেউ কীভাবে সামাল দেব! অভিজ্ঞ দু-একজন পরামর্শ দিলেন, ঢেউয়ের নিচ দিয়ে যেতে হবে, ওপর দিয়ে গেলেই নাকানিচুবানি খেতে হবে।
সাঁতার শুরুর আগে অন্যদের সঙ্গে একটু ব্যায়াম করে নিলাম। তারপর পানিতে নেমে পড়লাম। প্রথম দু-একটা ঢেউ ভালোমতোই পার করলাম। তৃতীয় ঢেউ আসতেই তাল হারিয়ে ফেললাম। দুই ঢোঁক পানি খেতে হলো। বিশুদ্ধ লবণপানি! তারপরও সাহস না হারিয়ে গভীরে যেতে থাকলাম। বিশাল সমুদ্রের বুকে একসময় দেখি আমি সবার শেষে। ভয় করছিল। তখন রাসেল ভাইয়ের কথাটা মনে পড়ল। নামার আগে আগে তিনি বলেছিলেন, ‘সামনের জনকে অনুসরণ করবে।’
সেন্টমার্টিনে ডিম পেড়ে গেল অলিভ রিডলি কাছিম
বাংলা চ্যানেল ১৯ বার পাড়ি দিয়ে রেকর্ড করলেন লিপটন
বাংলা চ্যানেলে প্রথমবার ‘ডাবল সাঁতার’ শুরু নাসরিনের
সামনে সাদা ক্যাপ দেখতে পাচ্ছিলাম। আবার ঢেউ তাঁকে আড়াল করে ফেলছিল। এভাবেই অনুসরণ করে করে এক ঘণ্টা সাঁতার কাটলাম। অনুশীলন করে আমার সাহস অনেকে বেড়ে গেল। ২৬ ডিসেম্বরও একইভাবে নামলাম। সেদিন আর নোনাপানি কাবু করতে পারল না। কিন্তু সবার পেছনে থাকায় মনের ভেতর একটা ভয় থেকেই গেল। সাঁতার শেষে গাব্যথায় জ্বর চলে এল। ২৭ ডিসেম্বর আর অনুশীলন করতে পারলাম না। রাত পোহালেই চূড়ান্ত সাঁতার। ভোর পাঁচটায় উঠে বাসায় কল করে সবার সঙ্গে কথা বললাম। মনকে যতটুকু শান্ত করা যায়, করলাম।
সাগরে নামতে নামতে সকাল সাড়ে নয়টা বেজে গেল। নামার ১০ মিনিট আগেও আমাকে বলা হয়েছিল, আমি হয়তো পারব না। সেই ‘পারব না’ কথাটাই জেদ হিসেবে কাজ করল। আর যা–ই হোক, আমি আজ আট ঘণ্টা সাঁতার কাটবই। পানিতে নামার পরপরই সহসাঁতারুকে হারিয়ে ফেললাম। একা। ভাবলাম সব শেষ। আমার মাথায় নানা চিন্তা। একসময় নিজেকে শান্ত করে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে এগোতে লাগলাম।
সকাল ১০টার কাছাকাছি। ওপরের নীল আকাশ দূরে সাগরের সঙ্গে মিশে আছে। সাগরে বিশাল বিশাল ঢেউ। আশপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো সবাই আগে চলে গেছে। আমার কানে তখনো বাজছিল, ‘ইলা, তুমি আট ঘণ্টায়ও পারবে না।’
একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম কত দূর এগিয়েছি। দেখে বুঝলাম, পেছনে ফেরারও আর উপায় নেই। তখন লম্বা করে শ্বাস নিলাম। এই ফাঁকে বিশাল ঢেউ আমাকে কাবু করার চেষ্টা করে। একসময় শান্ত হয়ে পণ করলাম, আজ ২৮ ডিসেম্বর। রেজাল্ট যা হয় হোক, আজ আমি আট ঘণ্টা সাঁতার কাটবই। ব্যর্থ হলেও সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারব, উত্তাল সাগরে আট ঘণ্টা সাঁতার কেটেছি।
আমার তখন লক্ষ্য ছিল প্রথমে বোট পর্যন্ত যাওয়া। সবার জন্য একটা করে বোট ছিল। আমার বোট ছিল এক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। আমি বোট পেলাম ৫০ মিনিট পর (সময় দেখার জন্য হাতে ঘড়ি ছিল)। বোট পাওয়ার পর একটু সাহস পেলাম। ঘণ্টা দুয়েক সাঁতারের পর আমার নেভিগেটরকে (বোটে থেকে যাঁরা দিকনির্দেশনা দেন) ধীরগতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, আমি স্লো সাঁতারু, তাঁরা যেন আমাকে একটু বেশি সাপোর্ট করেন। নেভিগেটর আশিক ভাই বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি স্লো আছেন, তবে আপনার পেছনে আরও দুজন আছে!’ কথাটা শুনে মনে আশার সঞ্চার হলো। সাহসও দ্বিগুণ বাড়ল। সাঁতারের গতি বাড়িয়ে দিলাম। এর মধ্যে খেজুর আর পানি খেয়ে নিলাম। তবে লবণপানি মিশে যাওয়ায় কলা আর খেতে পারিনি।
৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিট এভাবে সাঁতার কাটলাম। একসময় সৈকতের বালু দৃশ্যমান হলো। ততক্ষণে আমার হাত–পা আর চলে না। উচ্চতার কারণে পায়ের তলে বালুর নাগাল পেতে অন্যদের চেয়ে আমাকে একটু বেশিই সাঁতার কাটতে হলো। এভাবেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মাটিতে পা রাখলাম। প্রথমবারের মতো সেন্ট মার্টিনে পৌঁছালাম, তা–ও সাঁতার কেটে।

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *