fbpx
হোম অন্যান্য জন্মের পর থেকেই প্লাস্টিকের ভেতর ১২ বছর; অবশেষ ভাইরাসে মৃত্যু
জন্মের পর থেকেই প্লাস্টিকের ভেতর ১২ বছর; অবশেষ ভাইরাসে মৃত্যু

জন্মের পর থেকেই প্লাস্টিকের ভেতর ১২ বছর; অবশেষ ভাইরাসে মৃত্যু

0

একাকী একটি আবদ্ধ জায়গায় কিছুক্ষণ থাকলেই অস্বস্তি বোধ হয়, কিন্তু ভাবা যায় একাকী একটি প্লাস্টিক টিউবে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে জীবনযাপন করতে হবে? কিন্তু, এই অভাবনীয় জীবনই কাটাতে হয়েছে একটি নিষ্পাপ ব্যক্তির।

ডেভিড হেটর বা বাবল বয় নামে পরিচিত এক আমেরিকান বালক তার সারাটা জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছে  জীবাণুমুক্ত একটি প্লাস্টিক টিউবের ভেতরে। ডেভিডের শরীরে জন্ম থেকেই সঠিক প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি , তাই বাচ্চাটি জন্ম নিয়েছিল সিভিয়ার কম্বাইন্ড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি (এস সি আই ডি বা স্কিড) নামক এক বিরল রোগ নিয়ে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের জন্য সাধারণ বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া,পানি খাওয়া বা অন্য কোন কিছুর সংস্পর্শ মারনঘাতি হতে পারে।

মাতৃগর্ভ হতে বের হতে না হতেই ডেভিডকে রাখা হয়েছিল বিশেষভাবে তৈরী জীবাণুমুক্ত কোকুন বিছানায় যেন কোনরকম জীবাণু তার শরীরে সংক্রমিত না হতে পারে।জন্মের প্রায় তিন বছর পরে তাকে তার পরিবারের সবার সাথে থাকার জন্য তার বাসায় প্লাস্টিক টিউব স্থাপন করা হয় এবং সেই টিউবেই সে বড় হতে থাকে।

ডেভিডের মা-বাবার প্রথম সন্তানটিও এই একই রোগের কারণে জন্মের কিছুকাল পরেই মারা যায়, তখনই ডাক্তাররা তাদেরকে সতর্ক করেছিলেন যে পরবর্তীতে যদি কোন পুত্রসন্তানের জন্ম হয় তাহলে এই একই রোগটি সেই সন্তানের মধ্যে থাকার ৫০-৫০ চান্স আছে। প্রথম সন্তানের পরে তাদের দ্বিতীয় সন্তানটি হয় একটি মেয়ে,ক্যাথরিন ।ক্যাথরিনকে সঙ্গ দেয়ার জন্য তারা আরেকটি বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করেন এবং তার ফলাফলই ডেভিড।ডেভিডের মা-বাবা বিশ্বাস করতেন তখনকার চিকিৎসাবিজ্ঞানের যথেষ্ট উৎকর্ষ হয়েছে তাই হয়তোবা তারা তাদের সন্তানকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে পারবেন।

হেটরের জন্য যেই খাদ্যসামগ্রী,পানি,ডায়াপার বা খেলনা দেওয়া হতো তার সবই টিউবে প্রবেশের আগে একটি ইথাইলিন অক্সাইড বিশিষ্ট বিশেষ চেম্বারে ৬০॰ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চার ঘন্টার জন্য জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপরে সেই বস্তুগুলো গ্লাভস পরে টিউবের ভেতরে পাঠানো হতো। আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কোন জিনিসই জীবাণুমুক্ত করা ছাড়া ডেভিডের কাছে পৌঁছানো হতো না।

প্রথম প্রথম ডেভিড বুঝতে পারতো না কেন তাকে এইরকম বদ্ধ একটি টিউবে রাখা হয়েছে কিন্তু একটা সময় ভুলে ডাক্তার ডেভিডের টিউবের ভেতরে একটি প্রজাপতি সিরিঞ্জ ফেলে রাখে যেটি দিয়ে শিশুটি তার টিউবটি ফুটো করতে চায়,তখন ডেভিডকে তার শারিরীক অবস্থা এবং কেন সে বাইরে অন্যদের মতো ঘুরতে পারেনা সে বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়।

ছোট হলেও ডেভিড দারুণ বুদ্ধিমান আর মজার মানুষ ছিল।যদিও ডেভিডের কাছে তাকে নিয়ে মিডিয়ায় প্রচারিত খবরগুলো আড়াল করা হতো তারপরেও একদিন ডেভিড সংবাদপত্রে তার ছবি দেখতে পায় এবং তার মাকে বলে “মা,আমি একজন স্টার!”।বদ্ধ জীবনেও অন্য সবার মতো হাসি-ঠাট্টা করতে ভালবাসতো ডেভিড, অন্য আট-দশটা ভাইবোনের মতোই তার বোন ক্যাথরিনের সাথে তার ছিল চমৎকার সম্পর্ক এমনকি সে এই অবস্থায় কয়েকজন বন্ধুও জুটিয়ে ফেলেছিল।

এই বাবল বয়টির প্লাস্টিক টিউবে জীবাণুমুক্ত বায়ু প্রবেশের জন্য একটি প্রকান্ড ইঞ্জিন টিউবটির সাথে যুক্ত থাকতো, যার কারণে স্বাভাবিক কথাবার্তা চালানোর জন্যেও প্রচুর কষ্ট করে জোরে কথা বলতে হতো। তার বয়সী অন্যান্য বাচ্চাদের বাইরে খেলাধুলা করতে দেখে প্রচন্ড আক্ষেপ হতো ডেভিডের,সেই আক্ষেপ সামান্য মেটানোর জন্য নাসা একটি বিশেষ স্যুট বানায় যা তার টিউবের সাথে সর্বক্ষণ যুক্ত থাকবে। কিন্তু এরকম স্যুট পরে বাইরের দুনিয়ার সাথে মেশাটা ডেভিডের তেমন ভাল লাগেনি তাই ৭ বার ব্যবহারের পরে আর সেই স্যুট পরতে সে রাজি হয়নি।

সেই সময়কালে স্কিড রোগের কেবল একটিমাত্রই চিকিৎসা ছিল আর তা হচ্ছে বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কিন্তু ডেভিডের জন্য এই ব্যবস্থাটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।তা সত্ত্বেও ডেভিড এবং তার পরিবারের সদস্যরা এই ঝুঁকিটি নিতে রাজি হয়েছিলেন।কিন্তু সমস্যা ছিল ডেভিডের সাথে কারো অস্থিমজ্জার মিল পাওয়া যাচ্ছিল না।পরিশেষে বোন ক্যাথরিনের সাথে অস্থিমজ্জা না মিললেও দুজনের একইরকম কোষের দেখা পাওয়ায় ক্যাথরিনের অস্থিমজ্জাই ডেভিডের শরীরের প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জীবনের প্রথমবার ডেভিড কোন টিউব ছাড়াই সাধারণ দেখতে একটি জীবাণুমুক্ত হাসপাতালের কক্ষে শোয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। ডেভিড শিশুকাল থেকে কখনো তার মায়ের বা কারো হাতের স্পর্শ পায়নি কিন্তু অপারেশনের এই দিনগুলিতে প্রথমবার সে তার মায়ের চুম্বন অনুভব করে।

ডেভিড অনেক বেশী সাহসী ছিল তাই ডাক্তারের যেকোন কাজেই সে তাদেরকে সাহায্য করতো।ডাক্তার শিয়ারার বলেন,”তার সাথে যে কোন কিছু করার আগেই আমরা তাকে জানিয়ে নিতাম এবং সে তাতে খুব ভালোমতো সাহায্য করতো”। ডেভিড নিজের অনুভূতিগুলো অন্যের কাছে প্রকাশ করতো না,তাই এই ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ দিনেও সে স্ফূর্তির সাথে অন্য সবার সাথে কৌতুক করতো।

 

 

 

অস্থিমজ্জা স্থাপনের কিছুদিন পরেই হুট করে ডেভিড অসুস্থ হয়ে যেতে শুরু করে।প্রথমে অটোপসিতে তার মূল কারণ ধরা না পড়লেও পরে দেখা যায় ক্যাথরিনের স্থাপিত অস্থিমজ্জাতে ইপ্সটেইন বার ভাইরাস (ইবিভি) এর সূক্ষ্ম উপস্থিতি ছিল যা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের আগে প্রি-ট্রান্সপ্লান্ট স্ক্রিনিং এ ধরা পরেনি। সেই ভাইরাস দিয়েই সংক্রমিত হয়ে তা পরে মারণঘাতি ক্যান্সারের জন্ম দেয় যার কারণে ডেভিড প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে যায়।

অবশেষে টিউব থেকে বের হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ পরে ২২শে ফেব্রুয়ারী,১৯৮৪ সালে লিউকোমায় আক্রান্ত হয়ে ডেভিড শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে সে একবার চোখ টিপে দেয়,আর এটিই ছিল ডেভিডের শেষ ইশারা। মৃত্যু পরবর্তীতে স্কিড রোগের চিকিৎসার অগ্রগতি সাধনে অনেক ভূমিকা পালন করেছে যার জন্য এখনো ডাক্তার এবং গবেষকগণ তাকে গভীরভাবে স্মরণ এবং শ্রদ্ধা করেন।

সেপ্টেম্বর ২১, ১৯৭১ থেকে ফেব্রুয়ারী ২২, ১৯৮৪ দীর্ঘ বারো বছরের বন্দী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ডেভিডের। তাই হয়তোবা তার সমাধিস্তম্ভে লেখা – “He never touched the world but the world was touched by him ”

লেখক: নাহিদ সুলতানা তুলি

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
3

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *