fbpx
হোম জাতীয় বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব; কী করতে হবে ?
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব; কী করতে হবে ?

বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব; কী করতে হবে ?

0

মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তিকালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে আবার কথা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুটি দেশই বিপুলভাবে পাল্টে গেছে। তবে সম্পর্কটি পাল্টায়নি-এগোয়নি। এর বড় কারণ, তাদের সম্পর্কহীন সম্পর্কের মাঝে রয়েছে সচেতনভাবে আড়ালে রাখা অমীমাংসিত নানা প্রসঙ্গ। আছে জাতীয়তাবাদী আবেগের বাধা-বন্ধনও। প্রশ্ন উঠেছে, উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেসব অতিক্রম করে নতুন প্রজন্মকে ভিন্ন পথে নিতে পারবেন কি না। কীভাবে সেটা সম্ভব হতে পারে !

১৯৭০-এ পাকিস্তানের দুই অংশ মিলে জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটির মতো। এখন ৩৮-৩৯ কোটি।

বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ ভাগই একাত্তর দেখেনি। পাকিস্তানে নাগরিকদের ৮৯ ভাগের বয়স ৫০-এর কম। বাংলাদেশে একই বয়সসীমার নিচে আছে লোকসংখ্যার ৮৬ ভাগ। অর্থাৎ উভয় দেশে ‘একাত্তর’-এর প্রত্যক্ষদর্শী আছে অতি অল্পজন। কিন্তু জাতীয়তাবাদ তুমুল এক আবেগের নাম, যা সব সময় তরুণ থাকে। ফলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে স্বাভাবিক ও সাবলীল করতে একাত্তরের সব অমীমাংসিত বিষয়ের ফয়সালা করে এগোনোই ভালো হবে।

বিগত দশকগুলোতে অপ্রিয় বিষয়গুলো আড়াল করে পথ খোঁজা হচ্ছিল। সেই মডেল কাজ করেনি। পারস্পরিক ছাড় ও আদান-প্রদানের মনোভাব থেকে অতীত থেকে পাওয়া বিবদমান বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঐকমত্য হওয়ার মাধ্যমেই কেবল নতুন করে বন্ধুত্ব এগোতে পারে। সেটাই হবে উভয় দেশের নতুন প্রজন্মের জন্য স্বস্তিদায়ক। উভয়ের কাছাকাছি আসা দরকার ওই তরুণদের জন্যই।

একাত্তর ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই; ভুলে যাওয়ার প্রয়োজনও নেই। একই সঙ্গে সামনে এগোনোও যেতে পারে। সেটা জরুরি। সেটা সময়ের দাবি।

পাকিস্তান-ভারত যদি রাজনৈতিক সম্পর্কের নাজুকতার মাঝেও ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশও এই উভয় দেশের সঙ্গে সেটা চালাতে পারবে। পারা দরকার। ইউরোপ-আমেরিকার রাজনৈতিক খবরদারি থেকে বাঁচতে হলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাজার গড়া বাংলাদেশের জন্য বেশি জরুরি হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের বাজারমূল্য

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলে বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ ভাগ। এই দুই জনপদের যোগাযোগের বাজারমূল্য অনিবার্যভাবে বিপুল। অথচ ৩৯ কোটি মানুষের দুদেশ মিলে এখন ব্যবসা-বাণিজ্য মাত্র ৬-৭ শ মিলিয়ন ডলার। উভয় দেশের রপ্তানিতে এটা অতি সামান্য হিস্যা। ২০১৯-২০–এ বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে গেছে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। একে বিপুলভাবে বাড়ানোর সুযোগ আছে। উভয় দেশের শিল্প খাত গত ৫০ বছরে তুমুলভাবে প্রসারিত হয়েছে। আগের প্রজন্মের শিল্পপতিরা পরস্পরের মানুষ ও বাজার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেন। পরের প্রজন্মের শিল্পপতিরা সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারছেন না রাজনৈতিক পদক্ষেপের অভাবে।

ভারত-চীন গত এক বছর যুদ্ধ-উন্মাদনার মাঝে ছিল। অথচ এর মাঝেও প্রায় ১০৯ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছে। পাকিস্তান-ভারতের উদাহরণ হয়তো এ বিষয়ে আরও প্রাসঙ্গিক হবে। এই দুদেশ প্রতি সপ্তাহে গুলিবিনিয়ম করে। তিন দফা বড় আকারে যুদ্ধও হয়ে গেছে তাদের মাঝে। অথচ এর মাঝেও পণ্য বেচাবিক্রি করছে তারা। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ভারত থেকে পাকিস্তানে তিন শ মিলিয়ন ডলারের পণ্য গেছে। আগের বছর এটা প্রায় চার গুণ বেশি ছিল। ভবিষ্যতেও আগের অবস্থায় চলে যেতে পারে তারা। পাকিস্তান-ভারত যদি রাজনৈতিক সম্পর্কের নাজুকতার মাঝেও ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশও এই উভয় দেশের সঙ্গে সেটা চালাতে পারবে। পারা দরকার। ইউরোপ-আমেরিকার রাজনৈতিক খবরদারি থেকে বাঁচতে হলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাজার গড়া বাংলাদেশের জন্য বেশি জরুরি হয়ে উঠছে।

পাকিস্তান ২০১৯ থেকে ভিসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছে বাংলাদেশিদের। উভয় দেশ এসব আরও সহজ করে রপ্তানি বাণিজ্যকে বাড়তি গতি দিতে পারে। তাতে বাংলাদেশের যেমন পাট, চা ও তামাকের বাজার বাড়বে, পাকিস্তানেরও সুতা, চিনি ইত্যাদির রপ্তানি বাড়বে। তবে বর্তমানের একদিকে হেলে থাকা বাণিজ্যিক ভারসাম্য যাতে বাংলাদেশের জন্য আরেকটু সুবিধাজনক হয়, তার জন্য পাকিস্তানের তরফ থেকে নীতিগত মদদ দরকার। দীর্ঘ বিরতির পর পাকিস্তান ইতিমধ্যে বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রদূত পাঠিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নে কূটনীতিক আগ্রহের পরিচয় দিয়েছে। তাদের আরও এগোতে হবে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ক্ষত সারাতে অনেক দায় রয়েছে ইসলামাবাদের। অনেক পাকিস্তানি নীতিনির্ধারক চেয়েছেন বাংলাদেশ একাত্তরকে ভুলে সামনে এগোলে সুবিধা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের তরফ থেকে এটা সহজ নয়; সম্ভবও নয়। বরং ব্যবহারিক দিক থেকে সুবিধাজনক হবে একাত্তর অধ্যায় থেকে সৃষ্ট সমস্যার চটজলদি সমাধান। সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া নয়।

ইমরান খান কতটা সাহসী হতে পারবেন

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতি চর্চা করেছে। বৈশ্বিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের টানাপোড়েন এবং মুসলমানপ্রধান জগতে রিয়াদ ও তেহরানের ঠান্ডাযুদ্ধের মাঝেও বাংলাদেশ প্রায় সবার সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষা করছে। এটা সহজ ছিল না। দক্ষিণ এশিয়াতে সার্কের গোড়াপত্তনও বাংলাদেশের প্রস্তাব থেকেই। বিদেশ নীতিতে ঢাকার এসব শুভবোধে পাকিস্তানকেও জড়ানো যায়। তার মাধ্যমে অনায়াসে মধ্য এশিয়ার বিশাল জগতে নিজেকে মেলে ধরতে পারে বাংলাদেশ।

হামিদুর রহমান কমিশনের বক্তব্যের আলোকে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে পারেন। এ পদক্ষেপে উভয় দেশের সম্পর্কের বরফ অনেকখানি গলতে পারে।

এ মুহূর্তে আমাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। এই অগ্রগতিকে দীর্ঘ মেয়াদে মধ্য এশিয়ার ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নেও সম্প্রসারণ করা যায়। রাশিয়ার বাইরে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তানসহ চারটি দেশ আছে এই ইউনিয়নে। এর বাইরেও এ অঞ্চলে আরও দেশ আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও মধ্য এশিয়ায় বাংলাদেশ রাশিয়ানির্ভর হয়ে আছে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে। জনসংখ্যায় মুসলমান গরিষ্ঠতা এ দেশগুলোতে বাংলাদেশের জন্য বাড়তি সুবিধা হয়ে উঠতে পারে। উজবেকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। তার আশপাশের অন্য সব দেশেও কূটনীতিক পরিসর বাড়ানোর সুযোগ আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক মধ্য এশিয়া পৌঁছানো বাংলাদেশের জন্য সহজ করে তুলবে। বিনিময়ে বাংলাদেশের বাজারেও পাকিস্তানের হিস্যা বাড়বে দ্রুত।

এসবই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ স্তর থেকে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে। বিচারপতি হামিদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনেই প্রমাণ রয়েছে, দেশটির সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য বাংলাদেশে বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে অত্যাচার-নিপীড়ন-বাড়াবাড়ির জন্য স্পষ্টভাবে দায়ী। এ রকম সৈনিকদের অনেকেই বেঁচে নেই। সরকার চাইলেও হয়তো তাদের আর বিচার করতে পারবে না। কিন্তু হামিদুর রহমান কমিশনের বক্তব্যের আলোকে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে পারেন। এ পদক্ষেপে উভয় দেশের সম্পর্কের বরফ অনেকখানি গলতে পারে।

২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফরকালে এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে নওয়াজ শরিফ এসে একাত্তরের ঘটনাবলিকে বলেছিলেন ‘রাজনৈতিক অনাচার’। এসব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বেদনাবোধের ন্যায্য স্বীকৃতি। কিন্তু এ রকম সাধারণ দুঃখ প্রকাশে একাত্তরের ক্ষত সারবে না। এটা যথেষ্ট নয়। সংগত কারণেই তাতে সম্পর্ক গতি পায়নি। ভবিষ্যতে একই পথে না হাঁটাই ভালো হবে। বাংলাদেশের জনগণ এ বিষয়ে পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব থেকে স্পষ্ট ভাষার আরও সাহসী সিদ্ধান্ত আশা করছে। পাকিস্তানকে অবশ্যই সেনাবাহিনীর একাত্তরের ভূমিকার রাজনৈতিক দায় নিতে হবে আগে, যা স্পষ্ট হয় ‘ক্ষমা’ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে; ‘দুঃখ’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে নয় মোটেই। কেবল প্রিয়জন হারানো মানুষদের কাছেই নয়—কূটনীতিতেও এই দুই শব্দের তাৎপর্য ও প্রভাব বিস্তার ভিন্ন। এ রকম ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সমরবাদিতার বিপরীতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও মানবাধিকার সংস্কৃতিকে শক্তি জোগাবে।

এই প্রসঙ্গে গত পাঁচ দশকের অগ্রগতি হলো—পাকিস্তানের প্রায় ৫০টির মতো নাগরিক সংগঠন অনেক আগেই একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য ক্ষমা চেয়ে রাজনীতিবিদদের জন্য করণীয় সহজ করে রেখেছে। ইমরান খান ইতিমধ্যে তাঁর অনেক প্রথাবিরোধী পদক্ষেপে কূটনীতিকভাবে প্রশংসিত। বাংলাদেশ প্রশ্নেও তাঁকে পূর্বসূরিদের প্রথা ভেঙে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাকিস্তান যদি দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চায়—তাহলে একাত্তরে তাদের সেনাবাহিনী যে অপরাধ করেছে, তার দায় মেনেই পরবর্তী পথ এগোতে হবে। তখন এই সম্পর্ককে পথ করে এগিয়ে নেওয়া বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য সহজ হতে পারে। আর এ পথেই চলে আসতে পারে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রসঙ্গ ও একাত্তরের দায়-দেনা ভাগের বিষয়। তবে এগুলোর সমাধান মোটেই অতটা স্পর্শকাতর নয়—যতটা জটিল ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন।

যুদ্ধকালীন বর্বরতার অতীত থেকে কীভাবে আন্তর্দেশীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হয়, তার বড় উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সামনে রয়েছে জাপানের সঙ্গে চীন-কোরিয়ার সম্পর্ক। জার্মানি-ইসরায়েলের উদাহরণও টানা যায় একই বিষয়ে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্রিটেনের রানি ক্ষমা চেয়েছেন। এসবই আর কিছু নয়—নতুন বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার আন্তরিক ইচ্ছার প্রকাশ। এভাবেই ‘একাত্তর’-এর পাঁচ দশক পূর্তিকালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পর্কের নতুন একটা পথ তৈরি করে দিতে পারে। ২০২১ কি সে রকম এক বছর হতে চলেছে?

(আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক)
সাউথ এশিয়ান মনিটর থেকে নেয়া

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *