কে এই গাম্বিয়ার তামবাদু ?
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপড় নির্যাতন শুধু বাংলাদেশে পালিয়ে আসার মধ্য দিয়ে নয়, এটি মুলত ১৭৮৪ সাল থেকে চলমান নির্যাতন। থেমে থেমে আজকের এই অবস্থায় চুড়ান্ত পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের অবস্থা চরম অমানবিক।
সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট। যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচার তাগিদে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। মানবিকতার সর্বোচ্চ উদারতা দেখিয়েছে ছোট্র আয়তনের আমাদের বাংলাদেশ। কিন্তু একটা সময় তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে জেগে ওঠে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। শুরু হয় সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড়।
কিন্তু আজও কোনভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও অং সান সু চি নির্যাতনের কথা বিন্দুমাত্র স্বীকার করেননি। গত দুই বছরের বেশী সময় ধরে আন্তর্জাতিক নানা চাপে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাইলেও বাস্তবে তা রক্ষা করেনি মিয়ানমার। নানা অজুহাত এবং কারণ দেখিয়ে চলছে মিয়ানমার। এমনকি শান্তিতে নোবেল পাওয়া সু চি বরাবরই অস্বীকার করেছেন নির্যাতনের কথা। রোহিঙ্গারা নাকি নিজে থেকে বাংলাদেশে গেছে এমন দাবি করেন সু চি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
শুরু থেকে যে বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে মানবিক সহযোগিতার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ এবং সহযোগিতা করে আসছেন, তাদের মধ্যে গাম্বিয়া অন্যতম। মিয়ানমার কখনোই আইনের তোয়াক্কা করেনি। প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে গেছে আফ্রিকার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গাম্বিয়া। যার নেপথ্যে কাজ করেছেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবু বকর মারি তামবাদু। এরিমধ্যে উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতে।
মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) প্রথম দিনের শুনানিতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানো বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে গাম্বিয়ার আইনি দল। ১১ ডিসেম্বর সু চি তুলে ধরেন তার ভাষ্য। যেখানে আবারো অস্বীকার করেন রোহিঙ্গা নির্যাতনের কথা। আবু বাকার তামবাদু বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, ‘মিয়ানমারকে এ রকম নির্দয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বলুন। তাদের বর্বরতা বন্ধ করতে বলুন, যা আমাদের সবার বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। মিয়ানমারকে তাদের নিজেদের লোকদের ওপর গণহত্যা চালানো বন্ধ করতে বলুন।’ বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের মানবিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে এই বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে। আর সেই সঙ্গে আলোচনায় এসেছেন সেই আবু বকর তামবাদু।
কে এই তামবাদু ! এর আগে এমনটা কেউ করেনি যা তিনি করে দেখালেন ! মূলত আবু বাকারই মিয়ানমারের গণহত্যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন। অন্য কোন শক্তিধর রাষ্ট্রের যা সম্ভব হয়নি সু চিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সেটি তিনিই করেছেন যা ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। এই কারণে তাকে নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা।
তিনি একজন গাম্বিয়ান রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটির বিচারমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এর আগে কাজ করেছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা’তে। গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী দেশটির রাজধানী বাঞ্জুলের হাইস্কুলে পড়ালেখা করেছেন। এরপর যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন। পরবর্তীতে সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন আবু বকর তামবাদু।
তিনি ৬টি ভাষায় কথা বলতে পারেন।রোহিঙ্গা নির্যাতনের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সারাবিশ্বে এ নিয়ে তোলপার শুরু হলে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন তিনি । মুলত স্বাভাবিকভাবে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানতেন। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিও রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় তাঁর দেশের ভূমিকা রাখার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের বিষয়টিকে রুয়ান্ডা গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) কর্মরত ওই দুই দেশের কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে জানান, নিজের দেশে ২২ বছরের বেশী সময় স্বৈরশাসন, রুয়ান্ডার গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের আদালতে কাজের অভিজ্ঞতা আর সবার শেষে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবু বকর তামবাদু মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়ার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসেন। এবং বিভিন্ন সময় তিনি এসব বিষয় নিয়ে প্রতিবাদও করেছেন।
বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যেখানে দেখেও না দেখার ভান করছে। যে গণহত্যা আর অশ্রু তাদের কাছে মূল্যহীন। সেখানে বিশ্বের ছোট্ট এই একটি দেশ গাম্বিয়া এগিয়ে এলো। দু’হাত প্রসারিত করে মানবতার পাশে দাঁড়ালো।
ফলে উজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধ গাম্বিয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত এই গণহত্যার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ঠুকে দিয়েছে মামলা। গত মঙ্গলবার থেকে মামলাটির শুনানি চলছে। বিচার কার্যক্রমে মামলায় বাদি গাম্বিয়া, আসামি মিয়ানমার ছাড়াও ওআইসিসিসহ বেশ কিছু দেশ ও সংস্থা অংশ নিয়েছে। আদালতে অং সান সু চি মিয়ানমারের পক্ষে হাজির হয়েছেন। গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু।
উল্লেখ্য, গাম্বিয়া পশ্চিম আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ। রাষ্ট্রীয় নাম গাম্বিয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র। গাম্বিয়া নদী থেকেই দেশটির নামকরণ। এটি আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখন্ডের ক্ষুদ্রতম দেশ। দেশটির উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সেনেগাল দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর পশ্চিমে রয়েছে মহাসাগর। অথৈই নীল জলরাশির আটলান্টিক মহাসাগর।