নিঘাত সুলতানা
সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এই নতুন মহামারিতে নারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক, পারিবারিক—সব দিক থেকেই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন নারীরা।
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা; বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্সরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পুরো পৃথিবীতে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত লোকবলের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। আমাদের দেশেও এই সংখ্যা কম হবে না। ফলে যে রোগের এখনো কোনো ফলপ্রসূ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, সেই রোগের ক্ষেত্রে বিশাল ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই খাতের নারীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফেলোর স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহযোগী ডিন ন্যান্সি নিয়েলসেন বলছেন, স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যেসব নারী কাজ করেন, তাঁদের মা–বাবাসহ বয়স্কদের দেখভালের দায়িত্বও আছে। আবার স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের দেখাশোনাও করেন তাঁরা। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এসব নারীর ওপর আলাদা চাপ পড়ছে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী নারীরাই পরিবারের প্রাথমিক দেখভাল বা প্রিয়জনদের যত্ন করার দায়িত্ব পালন করেন। ফ্যামিলি কেয়ারগিভার অ্যালায়েন্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীতে ৭৫ শতাংশের বেশি নারী পরিবারের ক্ষেত্রে এই ভূমিকা পালন করেন। পুরুষেরা নারীদের সহযোগিতা করলেও পরিবারের সদস্যদের যত্ন বা সেবা করার ক্ষেত্রে নারীদেরই সময় দিতে হয় বেশি। হিসাব অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা ৫০ শতাংশ বেশি সময় দেন।
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু দেশ সম্পূর্ণ লকডাউন করা হয়েছে। এসব দেশে সবাই ঘরবন্দী হয়ে পড়ায় গৃহস্থালি কাজের চাপও এসে পড়ছে নারীদের ঘাড়ে। গত জানুয়ারি মাসে গ্যালাপের একটি জরিপ বলছে, সন্তানদের যত্ন ও দেখভালের ক্ষেত্রে প্রতিদিন পুরুষদের তুলনায় নারীদের ৭ গুণেরও বেশি সময় দিতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীদের ওপর সেই চাপ আরও বাড়ল।
করোনাকালে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবী নারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নারী-পুরুষ উভয়েই কাজ হারালেও পুরুষের চাইতে নারী কর্মজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, পুরুষরা দ্রুত অন্যত্র কাজ খুঁজে নিলেও নারীর ক্ষেত্রে এ সুযোগ কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরা কাজ হারিয়েছেন বেশি। মহামারীতে এসব খাতে কর্মরত নারীরাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে পোশাক খাত এবং হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক, প্রবাসী নারী শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষি ও গৃহকর্মে জড়িত নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়, করোনায় নারী নেতৃত্বাধীন পরিবারের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ।
লকডাউন চলাকালে কর্মজীবী নারীরা কীভাবে কর্মস্থল আর বাড়িতে সময় দিয়েছেন, তা নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একটি অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছে, যেখানে ২২২ জন কর্মজীবী নারী অংশগ্রহণ করেন। এতে দেখা গেছে কর্মজীবী নারীর কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনে করোনার প্রভাব বিস্তর। এ সময় তাদের পারিবারিক জীবনে কাজের চাপ বেড়েছে, কেননা বাড়িতে তখন সব সদস্যের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ছিল। পরিবারের কম বয়সী সদস্যদের স্কুল-কলেজ বন্ধ, গৃহপরিচারিকাদের ছুটি। সুতরাং বাড়তি চাপ হচ্ছে রান্না, কাপড় ধোয়া, হাঁড়ি-পাতিল মাজা, বাড়িঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখা, ছোটদের লেখাপড়ার তদারকি, বয়স্কদের যত্নসহ নানাবিধ কাজ।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভিন্ন। আমার কর্মস্থল এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ আমাকে একদিকে দিয়েছে কর্মের নিশ্চয়তা, সে সাথে চাপমুক্ত কর্মঘন্টা। এটা সম্ভব হয়েছে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা দক্ষতার ফলেই।
আমরা কেউই জানি না এই পরিস্থিতির কবে সমাপ্তি ঘটবে আর আমরা আগের জীবনে ফিরে যাব! গুগল, টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই তাদের কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে; কেননা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মীদের সুস্থতা নিশ্চিত করাও প্রতিষ্ঠানের নৈতিক দায়িত্ব। তাই আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা এই গবেষণার ফলাফলের আলোকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। যেমন- কর্মক্ষেত্রের সময়সীমায় পরিবর্তন আনতে পারেন বা দিনে দুই বা তিন শিফটের ব্যবস্থা চালু করতে পারেন। ফ্লেক্সিবল অফিস আওয়ারের কথা ভাবতে পারেন, যাতে সবাই একসঙ্গে অফিসে না গিয়ে সামাজিক দূরত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন। আবার বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করার ব্যবস্থাকেও অনুমোদন দিতে পারেন।
লেখক: গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ