ঈদে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব
দেশের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদকে ঘিরে পরিবার ও গ্রামমুখী সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে এক অনন্য ভালোবাসার সেতু বন্ধন। যান্ত্রিক জীবনে কর্মব্যস্ত মানুষ স্বল্প সময়ের জন্য নিজ গ্রাম, পল্লী ও পরিবারের নিকটে চলে আসে আনন্দ ভাগাভাগি করতে। সমাজের সর্বত্রই সৃষ্টি হয় পারিবারিক ও সমাজিক যোগাযেগ।
শহর ছেড়ে সাধারণত ৩ থেকে ১০ দিনের সফরে মানুষ গ্রামে অবস্থান করে। শুধু পরিবার-আত্মীয় স্বজন নয়, বৃহৎ পরিসরে দেখা হয় বাল্য বন্ধু, স্কুল বন্ধৃ, খেলার সঙ্গী, গ্রামের খেটে খাওয়া দিনমজুরসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে। অতি চেনা পরিচিত মানুষের সান্নিধ্যে এসে মানুষ ক্ষণিকের তরে ভুলে যায় দু:খ-বেদনা, ক্লান্তি-ক্লেশ। গ্রামের মাটির গন্ধ, পত্র-পল্লব, অপরুপ সবুজের হাতছানি, নির্মল বাতাস আর মানুষের পরিচিত হাক- ডাক- সম্বোধনে ফিরে আসে স্মৃতি সম্ভার। এসবের মাঝেই ঈদের ছুটিতে সুযোগ সৃষ্টি হয় মানুষকে সেবা দেয়ার, কমিউনিটি সৃষ্টির, পরিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার এবং সর্বপরি সামাজিক উন্নয়নের।
বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় সাধারণত ঈদে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে কিছু শুভেচ্ছা বিনিময়, পরিবারের সদস্যদের সাথে উপহার আদান প্রদান, ঈদের সেলামী প্রদান, ঈদের সালাত আদায়, ঘোরাঘুরি, একত্রে ভোজ, খেলাধুলা আয়োজন ও টিভি নাটক দেখে সময়কে আনন্দঘন করে থাকে। সচরাচর দেখা যায়, কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানর মধ্যেই অধিকাংশ মানুষ ঈদের ছুটি ব্যয় করেন। কিন্তু প্রচলিত এসব রীতিনীতির পাশাপাশি ঈদে অফুরন্ত সুযোগ আছে সমাজ সেবার। যে কোন ব্যক্তি বা সমিতি চাইলে সমাজ সেবার মাধ্যমে সামাজিক দায়দায়িত্বের উজ্জল দৃষ্টান্ত রাখতে পারেন। আর সেসব উদ্যোগ ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় উভয় দিক থেকে ইতিবাচক। আঞ্চলিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক প্রথা, ধমীয় দৃষ্টিভঙ্গি, জাতীয় চেতনা প্রভৃতি ভিন্ন-ভিন্ন উপায়ে সমাজ সেবা দেয়া যায়।
প্রথমত আসি পরিবারের কথায়। সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পারিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম আদিম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। পরিবার মানব সমাজের অন্যতম ভিত্তি। মানুষের অস্তিত্বের সাথে পরিবারের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জড়িত। আর ইসলামে পারিবারের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। পরিবারে ও আত্মীয়তার সম্পর্কের মাঝে ছোট ছোট অভিমান থেকে যেসব চির ধরে, তা মুছে দেয়ার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে ঈদ।
ঈদে প্রতিটি মানুষের কার্য তালিকায় থাকা উচিৎ: অসুস্থ -রোগাক্রান্ত আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নেয়া এবং ভালো চিকিৎসার ব্যাপারে সচেতন করা, পরিবারের সদস্যদের সাথে ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি পর্যালোচনা করার পাশাপাশি আধুনিক তথ্য ও সমাজ প্রবাহ সম্পর্কে মতবিনিময় করা, ব্যক্তিগত জীবনে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক পরামর্শ দেয়া, পরিবারের ছোট সদস্যদেরকে শিক্ষা বিষয়ক পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দেয়া, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে পরস্পর মতবিবিনময় করা, সামর্থ থাকলে নতুন-নতুন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ গ্রহন করা, সর্বপরি ফ্যামিলি গেটটুগেদার ও প্রীতিভোজের মাধ্যমে সম্প্রীতিকে সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌছানোর ব্যবস্থা করা।
শুধু ক্রয়, উপভোগ আর বিনোদনের মাধ্যমে সময় কাটিয়ো দিলে সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সমাজ হলো সকলেল সমণ্বিত রুপ, একে লালন করার দায়িত্বও সবার। একটি সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মাণ করা সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। সামাজিক উদ্যোগের কাজ হতে পারে বহুমুখী ও বিস্তৃত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা বন্ধু ও সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে সামাজিক সংস্থা গঠনের মাধ্যমে যেসব সামাজিক উন্নয়ন মূলক কাজ করা যায় তার কিছু নমুনা উপস্থাপন করবো।
প্রথমত, ধর্মীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে যাকাত ও সদকাতুল ফিতর আদায় এবং বণ্টনের একটি অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহন করা। খুব সাধারণ ভাবে ১০ জনের যাকাত একত্র করে একজন অসহায় দুস্থ মানুষকে পূনর্বাসন করা য়ায়। এ ক্ষেত্রে স্থায়ী আয় বর্ধক প্রকল্প যেমন গাভী ক্রয় করে দেয়া, ভ্যাান গাড়ী ক্রয় করে দেয়া বা ছোট দোকান করে স্বল্প পুঁজির ব্যবসা চালু করে দিয়ে এক বা একাধীক মানুষকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করা যেতে পারে।
একটি সচেতন জনপদ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষা বঞ্চিত তরুণ, যুবক ও বয়স্কদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষা প্রদানের প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে। সাধারণ শিক্ষাদান কেন্দ্র, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, গণশিক্ষা, নৈশ শিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা ; যা বয়স্কদের নাগরিক দায়িত্ব পালনে ও স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে সহায়ক হবে। গ্রামের কিছু সৎ সচেতন তরুণ যারা গ্রামেই অবস্থান করে, তাদেরকে সাথে নিয়ে এ ধরণের কার্যক্রম শুরু করে দেয়া যায়। সবেমাত্র নতুন সেশনে এইচএসসি ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীরা সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে বা অর্থের অভাবে শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারছেনা। তাদের জন্য ইতিবাচক কিছু করার এখনই সময়। বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে দরিদ্র মেধাবী ছাত্র- ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করা, ছাত্র, শিক্ষক ও সাধারণ লোকদের জন্য ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী স্থাপন করা এবং পাঠাগার স্থাপন করে শিক্ষানুরাগী সৃষ্টি করা যেতে পারে।
জন কল্যাাণমূলক কাজ, যেমন- মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র বা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, অস্থায়ী হেলথ ক্যাম্প, তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য জলে ও স্থলে ভ্রাম্যমান হাসপাতাল, গরীব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণ করাসহ স্বাস্থ্য সেবায় অবদান রাখতে পারেন সচেতন ব্যক্তি সমাজ।
জনসচেতনতা মূলক কাজের জন্য অফুরন্ত সুযোগ আছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে। সচেতনতার জন্য গণশিক্ষামূলক পোষ্টার এবং অডিও-ভিডিও নির্মান করে তা জন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায় খুব সহজ উপায়ে। পরিবেশ সচেতনতা, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি সুরক্ষা, মাদক বিরোধী গনমত সৃষ্টি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কাজ করে একটি সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের ভিত রচনা করা সম্ভব।
পল্লী অঞ্চলে ভূমিহীন, দরিদ্র ও বেকার মহিলা- যুবকদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদেরকে সরাসরি উৎপাদনে সম্পৃক্তকরণ ও পরিবারে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ধীরে-ধীরে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য সহায়তা প্রদান করা যায়। এটা হতে পারে যাকাতের অর্থে বা স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে বিশেষ তহবিল গঠনের মাধ্যমে। অবহেলিত জনপদে মানুষের নিত্য দিনের প্রয়োজন পুরণের জন্য নলকুপ স্থাপন, সেনিটেশন, গৃহায়ন ইতাদি প্রয়োজনীয়তার উপর সহযোগিতার হাত বাড়ােনো একটি মহৎ উদ্যোগ হতে পারে। মহাজনি চড়া সুদে টাকা লগ্নী করা, ফসল অগ্রিম বিক্রি, বন্ধক প্রথা ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে কমানো বা উচ্ছেদ করতে সহায়তা করা । এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে কাজ করা এবং দরিদ্র মানুষদের সচেতন করা জরুরী। এভাবে দরিদ্র মানুষ ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হবার পথ খুজে পাবে। সামাজিক বনায়ন তথা বিভিন্ন স্তরে বৃক্ষরোপন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
বৈদেশিক সাংস্কৃতিক নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় সংস্কৃতির লালন ও সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যবস্থা করা এবং ঈদ পূনর্মিলনী সহ সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে দেশীয় সাংস্কৃতিক ও শালীন বিনোদনকে উদ্বুদ্ধ করা সময়ের দাবী। এ দাবী পূরণে এগিয়ে আসতে হবে তরুণ যুবকদেরকে।
মাদক ও ধুমপান বন্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গণসচেতনতা তৈরী ও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, অসহায় বিপদগ্রস্থ অন্যায়ভাবে আটক ব্যক্তির কারামুক্তির ব্যাপারে বা সমাজে বিচার বঞ্চিত মানুষের ব্যাপেের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আইনগত সহায়তা দান করা।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মক্তব, কবরস্থান উন্নততর ব্যবস্থাপনার জন্য সংস্থা গঠন, সহায়তা প্রদান, তদারকি, নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা করা।
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগ প্রবণ দেশ। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো একটি উন্নত মানের সমাজ সেবা। বন্যা, ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও বিনা সূদে ঋণকার্য পরিচালনা করা যেতে পারে সম্মিলিত উদ্যোগে।
সমাজে বসবাসরত শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্দশাগ্রস্থ, বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধি, দুঃস্থ ও ভিক্ষুক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায়। বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত অসহায় মহিলাদের সঠিক তত্বাবধান ও পূনর্বাসনের জন্য কল্যাণকর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এ ছাড়া যৌতুক মুক্ত বিবাহের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা, বাল্য বিবাহ রোধসহ কন্যা দায়-গ্রস্থ পিতাকে সাহায্য করাও হতে পারে ভিন্নধর্মী সামাজিক উদ্যোগ।
মানবধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাকে দেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সচেতন নাগরিকদের নিয়ে গ্রামীণ জনপদে সকল প্রকার বৈষম্য ও নির্যাতন বিরোধী কমিটি গঠন এবং শিশু শ্রম বন্ধ করে শিশু অধিকার বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আমরা বিদ্যমান ব্যবস্থায় দেখতে পাই, ঈদ উপলক্ষে রাজনৈতিক নেতারা কিছু উপহার সমাগ্রী বিতরণ করে থাকেন মানুষের সমর্থন লাভের আশায়। সেটা ইতিবাচক; তবে এসব উদ্যোগ হওয়া উচিৎ সকল মানুষের জন্য, শুধু দলীয় বিবেচনায় নয়।
উল্লেখিত সামাজিক দায়িত্ব পালনের পাশাপশি বর্জন করতে হবে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, রাজনতিক কলহ এবং বিশৃঙ্খলা। ঈদকে ঘিরে পুরনো দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলুন সকলেই। সৃষ্টি করুন নতুন নতুন সামাজিক সংগঠন। আর সামাজিক মূল্যবোধ তৈরীর জন্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করুন বক্তব্য, গেটটুগেটার, ঈদ পূনর্মিলনী ও সম্প্রীতি সভা। এসব সামাজিক আচারের উদ্দেশ্য হলো, একটি শোষণমুক্ত, সাম্যাবস্থা সৃষ্টি করা। যাতে সমাজ ব্যবস্থা স্থিতিশীল ও সমম্মানজনক হয় সবার জন্য। দেশ ও সমাজে বহমান নষ্ট সংস্কৃতি যেখানে দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে প্রস্তুত, সমাজে যেখানে ভাঙন একটি নৈমত্তিক ব্যাপার, সেখানে একটি শান্তিপ্রিয় সমাজ গঠনের একক হতে পারেন প্রতিটি সচেতন নাগরিক।
ঈদ আনন্দ হোক সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে। তবে ঈদ মৌসুমে সকল ভ্রমন যেন নিরাপদ হয়, সে ব্যাপারে অতিরিক্ত মনযোগ ও ধৈর্য সবার নিকট কাম্য। অবশ্যই ঝুকিপূর্ন ভ্রমন বর্জন করতে হবে।।