প্রশংসার জন্য আমি সাগরে ঝাঁপ দিইনি
১৫ জুন দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা থেকে যাত্রীবাহী জাহাজ সন্দ্বীপ উপকূলে ভেড়ে। এরপর লাল বোটযোগে (লাইফ বোট) যাত্রীরা উপকূলে নামতে শুরু করেন। প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় লাল বোটের এক যাত্রী সন্দ্বীপ চ্যানেলে পড়ে যান। ওই যাত্রীকে পানিতে ডুবতে দেখে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন লাল বোটটির মাঝি মো. মামুন। সাহসী এ কাজ করে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সীতাকুণ্ড ,
মো. মামুন
প্র:
কেমন আছেন?
মো. মামুন: শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ। গায়ে জ্বর। গত বুধবার (২১ জুন) যাত্রী নামানোর সময় বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলাম। এরপর থেকে হাঁচি, কাশি ও জ্বর শুরু হয়। তাই বাসায় শুয়ে আছি।
প্র:
আপনি তো সন্দ্বীপ চ্যানেলে পড়ে যাওয়া যাত্রীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। সবাই আপনাকে বাহবা দিচ্ছে। কেমন লাগছে?
মো. মামুন: দীর্ঘদিন ধরে এই পথে যাত্রীদের ওঠানো-নামানো করছি। এই নদীর ঢেউ সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। প্রশংসার জন্য আমি সাগরে ঝাঁপ দিইনি। যাঁরা আমার নৌকার যাত্রী হয়েছেন, তাঁদের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। তবে ঘটনাটি জানাজানির পর অনেক মানুষ ঘাটে এসে আমার প্রশংসা করছেন। আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইছেন। আমার নৌকায় উঠতে নিরাপদ বোধ করছেন, এটাই আমার বড় পাওয়া। আমার কোটি টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এটুকুতেই সন্তুষ্ট।
প্র:
উত্তাল ঢেউয়ে যখন ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তখন ভয় লাগেনি?
মো. মামুন: ভয় যদি আমি নিজেই পাই, তাহলে যাত্রীদের বাঁচাব কী করে? এর চেয়েও বেশি ঢেউয়ে সন্দ্বীপ চ্যানেলে সাঁতার কেটেছি।
প্র: ঝাঁপ দেওয়ার সময় আপনার কী চিন্তা হয়েছিল?
মো. মামুন: তখন লোকটিকে বাঁচানো ছাড়া অন্য কোনো কিছুই মাথায় ছিল না। কারণ, ১-২ মিনিট দেরি করলেই লোকটি পানিতে ডুবে মারা যেত। তখন নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী মনে হতো। আমার শুধু এটা মনে হয়েছে, লোকটিকে বাঁচাতেই হবে।
প্র:
এই কাজের জন্য আপনাকে কেউ পুরস্কৃত করেছে?
মো. মামুন: আসলে মানুষটিকে উদ্ধার করা পুরস্কারের জন্য ছিল না। এটি ছিল বিবেকের তাড়না। তবু একটি সামাজিক সংগঠন থেকে এক ভাই এসে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে একজন একটি কার্টন ভর্তি করে বাজারসদাই ও দুই হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। তবে এটা ভালো লাগছে যে এখন জাহাজ থেকে নামার সময় অনেক যাত্রী আমাকে খোঁজেন।
প্র:
কত বছর ধরে নৌকা চালাচ্ছেন। আর কতটি ঘটনা এমন দেখেছেন?
মো. মামুন: শুধু গুপ্তছড়া ঘাটে ২২ বছর নৌকা চালিয়েছি। এর মধ্যে ছোট–বড় অনেক দুর্ঘটনা দেখেছি। গত বছর যাত্রীবাহী কাঠের ট্রলার থেকে ৭-৮ বছরের এক বাচ্চাকে নিয়ে এক ব্যক্তি আমার নৌকায় নামার চেষ্টা করছিল। এ সময় ঢেউয়ের কারণে ট্রলার থেকে নৌকাটি কিছুটা দূরে চলে যায়। এতে বাচ্চাটিসহ ওই ব্যক্তি পড়ে যান। তখন আমার পকেটে স্টাফদেরসহ তিনটি মুঠোফোন ছিল। মুঠোফোনের কথা চিন্তা না করে ঝাঁপ দিয়ে শিশুকে নিয়ে প্রথমে নৌকায় তুলি। এরপর ওই ব্যক্তিকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করি। তখনো ওই ব্যক্তি কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। আমি নিইনি। প্র : আপনার বাসায় কে কে আছেন।
মো. মামুন: মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।
প্র:
ওই দিনের ঘটনায় আপনার পরিবারের লোকজনের অনুভূতি কী ছিল?
মো. মামুন: ঘটনাটি প্রথম দিন বাড়িতে বলিনি। কিন্তু পরদিন সেটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর মা বলেন, তোর দুইটা মেয়ে, একটা ছেলে ও আমি আছি। আমাদের কথা তোর একটাবারও মনে ছিল না! তোর কিছু হলে আমাদের কে দেখত? কিন্তু আমি তাদের বলেছি, এটাই আমার কাজ। আমার নৌকা থেকে কারও প্রাণ যাবে, সেটা তো আমি হতে দিতে পারি না। তারাও জানে আমি তাদের এ ধরনের কথা শুনব না। তবু তাদের বলেছি, আমার জন্য দোয়া করো। আমার কারণে যেন কারও মৃত্যু না হয়।
প্র:
আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. মামুন: আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রথম আলো