বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর বাকি আছে ১০০ ঘন্টারও কম। নির্বাচন নিয়ে চাপা অস্বস্তি এখনো কাটেনি ভোটার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাঝেও। নির্বাচন হবে কিনা, বিরোধী পক্ষ নির্বাচন বর্জন করবে কিনা, নির্বাচন বানচাল তত্ত্ব ইত্যাদি নানা রকম গুঞ্জনের মাঝে কূটনৈতিক তৎপরতার দিকেও দৃষ্টি রাখছেন দেশের নাগরিক সমাজ।
বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে অতীতের অনেক দৃশ্যমান তৎপরতা এ দফায় গোপন চরিত্র ধারণ করেছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশ ভারত কেবল দৃশ্যমান নয়, বরং গতিশীল তৎপরতা দেখিয়েছিল এবং ব্যাপক প্রতিক্রিয়াশীল ছিল। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে আনতে প্রভাবিত করেছিলেন। সেটা ছিল তৎকালীন সময়ের বহুল আলোচিত কূটনৈতিক তৎপরতা। ভারত আগে থেকেই বলে আসছে এবারের নির্বাচনে তারা নাক গলাবেনা। বাস্তবে ভারতের তৎপরতা সাধারণ ভোটারদের নিকট দৃশ্যমান না হলেও এটি অবিশ্বাস্য যে, ভারতের নীতি নির্ধারকরা একেবারেই নীরব দর্শকের মত বসে আছেন!
বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক প্রেরণ এবং নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে দেশে অবস্থানরত কূটনৈতিক মিশন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশী গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে তাদের অভিমত ও বিবৃতি। ২৫ ডিসেম্বর অনলাইন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সাংবাদিক শুভজিত রায় লিখেছেন ‘ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রচারণার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দলীয় জোট তাদের রণকৌশল নির্ধারণ করেছে।’ তিনি আরো লিখেছেন ‘উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি বিষয় হলো সংখ্যালঘুদের সঙ্গে আচরণ, যাকে একটি ‘স্পর্শকাতর ইস্যু’ হিসেবে দেখা হয়। এ ইস্যুটি ক্রমবর্ধমান হারে ঢাকায় কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করছে।’
সম্প্রতি নিক্কি এশিয়ান রিভিউয়ে তাদের স্টাফ রাইটার ইউজি কুরোনুমা লিখেছেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। এবারের নির্বাচনের ওপরও বিতর্ক ছায়া ফেলেছে। এ বছরের শুরুতে শেখ হাসিনার কয়েক দশকের প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির অভিযোগে জেল দিয়েছে আদালত। একজন নিত্যপণ্যের বিক্রেতার কণ্ঠে সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিধ্বনি হলো। তিনি বললেন, খালেদা জিয়ার ওই জেল দৃশ্যত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এতে সুষ্ঠু নির্বাচনকে খর্ব করা হয়েছে।’
ঢাকায় নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাতকালে বলেন, “আমরা আশা করি আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ হবে”। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, “বৈঠকের আলোচনায় বাংলাদেশের ১১তম সাধারণ নির্বাচন উঠে আসে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে মার্কিন দূতাবাস মোট ১১টি দল গঠন করবে, যাতে ৩২ জন মার্কিন পর্যবেক্ষক থাকবেন”।
ঠিক এর ৫ দিনের মাথায় জানা গেল যুক্তরাষ্টের অর্থায়নে নিয়োজিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা আনফ্রেল প্রকতনিধিরা ভিসা জটিলতার কারণে আসতে পারছেন না। এ ঘটনায় হতাশা ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। ভিসা ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা আনফ্রেল বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষ্যে তাদের মিশন স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আনফ্রেলকে সহযোগিতা ও অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার তাদের পর্যবেক্ষণ মিশন স্থগিতের সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের উপমুখপাত্র রবার্ট পাল্লাডিনো এক বিবৃতিতে এ কথা জানান।
এবং ঘটনায় তড়িৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মার্কিন দূতাবাস। ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ওই মিশন চালাতে অর্থায়ন করেছিল। কিন্তু যথাসময়ে পরিচয়পত্র ও ভিসা না পেয়ে আনফ্রেল তাদের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
এর আগে ডিসেম্বরের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছিল, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের সহায়তা করবে। যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে মিলে দেড় হাজার স্থানীয় পর্যবেক্ষককে অর্থায়নও করছে দেশটি।
এসব ঘটনার মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জোটের আহবায়ক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে। বৈঠক শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, এখানেও তিনি একই বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে বলে তিনি আশা করেন। নির্বাচনী সহিংসতা বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিস্থিতি ঠিক রাখতে সব দলকে সহিংসতা পরিহার করতে হবে।জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, তুরস্ক, ডেনমার্ক, ফিলিপাইন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ ৩৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
চলতি মাসের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুন:নিশ্চিত করার আহবান জানিয়ে একটি রেজুলেশন পাস করেছে মার্কিন কংগ্রেস। কংগ্রেসের নিন্মকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে সর্বসম্মতিক্রমে রেজুলেশনটি পাস হয়।
এসব তৎপরতায় বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশীজনদের একটি পক্ষ স্বস্তি অনুভব করলেও অপর পক্ষ কর্ণপাত করছেনা । সরকারের অবস্থানের কারণে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হুমকির মুখে পড়ছে বলে বিবৃতি প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট (ইপি) আগেই জানিয়েছে, আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে না। ইপি’র ডেমোক্রেসি সাপোর্ট অ্যান্ড ইলেকশন কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের দুজন সহযোগী চেয়ারপারসন ডেভিড ম্যাকঅ্যালিসটার ও লিন্ডা ম্যাকঅ্যাভান এক বিবৃতিতে জানান, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে না এবং ফলাফল নিয়েও কোনো মন্তব্য করবে না। এছাড়া, ইইউ মিশনও এবার বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইপি’র কোনো সদস্য যদি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেন সেটা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতামত হিসেবে বিবেচিত হবে না। গত ১৫ নভেম্বর ইপি তাদের রেজুলেশনে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলে, বাংলাদেশের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক হবে যেন নাগরিকরা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কূটনৈতিক তৎপরতা ইতিবাচক ফল আনবে বলে এক ধরণের প্রচ্ছন্ন ধারণা পোষণ করে বিএনপি ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। বাস্তবে কূটনৈতিক তৎপরতাকে খুব বেশী গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেনা সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা। তবে রাজনীতির মাঠ হঠাৎ উত্তপ্ত হলে কূটনৈতিক তৎপরতা নতুন রূপ ধারণ করতে পারে। ভোট গ্রহণ শুরুর আর অল্প সময় বাকি, তবু ভোটাররা চাপা অস্বস্তিতে আছে সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা ভেবে।