fbpx
হোম দর্শক ফোরাম সাম্রাজ্যবাদ: ঠান্ডা যুদ্ধের এ টু জেড
সাম্রাজ্যবাদ: ঠান্ডা যুদ্ধের এ টু জেড

সাম্রাজ্যবাদ: ঠান্ডা যুদ্ধের এ টু জেড

2

বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে অতিপরিচিত শব্দ হলো সাম্রাজ্যবাদ। প্রথমেই আসা যাক সাম্রাজ্যবাদের উৎপত্তি ও উত্তরণের দিকে। সাম্রাজ্যবাদ বলতে বুঝায়, ‘অন্য রাজ্যের উপর কতৃত্ব ও অধিকার’। পৃথিবীর শুরুর দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদ শব্দটার কার্যকরী প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। তবে বর্তমান সময়ের সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের উৎপত্তি ও সংজ্ঞায়ন নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

আধুনিককালে সাম্রাজ্যবাদকে ‘উপনিবেশবাদ’ দিয়ে বিচার করা হয়। কেউ কেউ বলেন, উপনিবেশবাদ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ অর্থহীন। আবার কেউ কেউ বলেন, আনুষ্ঠানিক সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিকতা ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। তবে আমরা যদি নির্দিষ্ট পথ ধরে এগোতে যাই তাহলে বলতে হয়, সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদে’র ফল। ঊনবিংশ শতাব্দি ও তাঁর পূর্ববর্তী সময়গুলোতে পুঁজিবাদই ছিলো সাম্রাজ্যবাদের ধারক। শিল্পপুঁজি’র মাধ্যমেই গড়ে উঠে পুঁজিবাদের মূলতন্ত্র এবং সেখান থেকেই বিকাশ লাভ করে সাম্রাজ্যবাদ। ১৮৭০ সালের পর সমাজবিজ্ঞানীরা সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব ও তথ্য বৈষয়িকভাবে প্রদান করে থাকেন। সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ও সমাজবিজ্ঞানী ‘জে এ হবসন’। তাঁর মতে, নব্য উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনীতি। হবসন আরো বলেন, এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিবাদীরা মুনাফা ভোগ করে বহু মূলধন জমা করে। এর ফলে মূলধনের পাহাড় জমে যায়। এই মূলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আরো মুনাফা বৃদ্ধির জন্য পুঁজিপতিরা তাদের নিজ দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে। উপনিবেশের নতুন শিল্পে মূলধন লগ্নি করে পুঁজিপতি শ্রেণি মুনাফার পাহাড় জমায়। উপনিবেশের কাঁচামাল ও বাজারকে একচেটিয়া দখল করে তারা ফুলে ফেঁপে ওঠে। সুতরাং নব্য সাম্রাজ্যবাদের মূল অর্থনৈতিক শিকড় ছিলো উপনিবেশে লগ্নির জন্য “বাড়তি মূলধনের চাপ”। অর্থাৎ বাড়তি মূলধনের চাপই সাম্রাজ্য বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ।

বিখ্যাত সাম্যবাদী নেতা ও রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ ভ্লাদিমির এলিচ লেনিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা আরো জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, পুঁজিবাদের ভেতরেই সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিহিত আছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বৈদেশিক নীতি পুঁজিবাদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়। অধিক মুনাফার আশায় শিল্প মালিকরা দেশের লোকের প্রয়োজন অপেক্ষা বাড়তি পণ্য উৎপাদন করে। এই বাড়তি পণ্য বিক্রয় ও সস্তায় কাঁচামাল পাওয়ার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখল করে।

লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে বিভিন্ন পুঁজিবাদী শক্তির উপনিবেশ দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দায়ী করেন। এক্ষেত্রে অন্যতম একটি আলোচ্য বিষয় হলো ‘যুদ্ধ’। যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, কেননা যুদ্ধ হলো পুঁজিবাদ অর্থনীতির চূড়ান্ত পরিণতি। আমরা যদি প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত পরিণতির কথা বলতে চাই তাহলে আমাদেরকে ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের’ আলোচনা করতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ খতিয়ে দেখলে আমরা পুঁজিবাদের বিশাল এক অধ্যায় দেখতে পাবো। কলোনিয়ালিজম তথা নিজ রাজ্যের বাহিরে অন্য স্টেটগুলোকে নিজেদের আধিপত্যে রাখতে তৎকালীন রাজ্যপালরা ছিলো মরিয়া। যার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অনেকাংশে অনিবার্য হয়ে পড়ে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে জার্মানীর উপর অতিরিক্ত জরিমানা ও জার্মানীর বিভিন্ন অংশ দখল করে নেওয়ার মধ্যেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। সুতরাং আমরা এখানেও বলতে পারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদের দ্বান্দিক ফল। তার পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ‘কোল্ড ওয়ার বা ঠান্ডা যুদ্ধ’ ছিলো সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের চরম অধ্যায়। এই সময়ের মধ্যেই আধিপত্যবাদদের সাম্রাজ্যবাদের চরম চিত্র ফুটে উঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল খলনায়করা অর্থাৎ ‘আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘ নিজেদের ইচ্ছামতো ছোটো স্টেটগুলো ভাগ করে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে ‘ভিয়েতনাম, জার্মানী, কোরিয়া’ ছিলো অন্যতম। আমেরিকা তাঁর কলোনিগুলোতে ‘ন্যাশনালিজম’ এর নামে আধিপত্য বিস্তারের জন্য সাম্রাজ্যবাদের এক চরম প্রোপাগান্ডা চালায়। এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নও বসে থাকেনি। পূর্ব জার্মানি, উত্তর কোরিয়া ও উত্তর ভিয়েতনাম ছিলো সোভিয়েত ব্লকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসব দেশে ‘কমিউনিজম’ এর এক মহামারী ছড়িয়ে দেয় যার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়। তবে বাকি বিশ্ব যে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদের বাহিরে ছিলো তা কিন্তু নয়। পুরো বিশ্ব তখন দুটি ব্লকেই ভিভক্ত ছিলো। আর তা হলো ‘ন্যাশনালিজম ও কমিউনিজম’। এই ঠান্ডাযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ন্যাশনালিজম ও কমিউনিজমের আদলে স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়।

যারা ন্যাশনালিজম তথা আমেরিকার জাতিয়তাবাদী নীতি গ্রহন করেছিলো তারা পেয়েছিলো আমেরিকার সাহায্য আর যারা কমিউনিজম তথা কমিউনিজম তথা সমাজতন্ত্রকে মনে-প্রাণে ধারন করেছিলো তারা পেয়েছিলো সোভিয়েতের সাহায্য। কিন্তু এর মধ্যেই যে মোড়লদের সাম্রাজ্যবাদনীতি লুকায়িত ছিলো সেটা শিশুরাষ্ট্রগুলো খুব কমই বুঝতে পেরেছিলো। ১৯৯০-৯১ এর দিকে ‘মিখাইল গর্ভাচেভ’ এর দুর্বলতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে নি। তখন প্রতিষ্ঠা হয় রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। শেষ হয় ‘কোল্ড ওয়ার বা ঠান্ডাযুদ্ধ’।

সর্বোপরি বিজয় লাভ করে ন্যাশনালিজম অর্থাৎ আমেরিকা। সারা বিশ্ব হয়ে যায় এককেন্দ্রিক। বেশিরভাগ রাষ্ট্র ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ন্যাশনালিজম এর গোলাম হয়ে পড়ে। নতুনভাবে শুরু হয় আমেরিকার আধিপত্য। শুরু হয় অস্ত্র ও অর্থনীতির রাজত্ব । আর এতে আমেরিকার কোনো জুড়ি ছিলো না। আমেরিকা সরাসরি রাজত্ব না করলেও অস্ত্র দিয়ে পরোক্ষ রাজনীতি এখনো চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই। তবে এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক রাজত্বে নতুন এক দাদার আগমন ইতোমধ্যে ঘটে গেছে । একবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে নতুন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীনের উত্তরণ খুবই চোখে পড়ার মতো। বর্তমান বিশ্ব আধিপত্যবাদে চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কোনো অংশে কম নয়। তবে চীনের যে অস্ত্রের রাজত্ব নেই তা কিন্তু নয়। তাঁর একটি বড় উদাহরন হলো, প্রতিদিন ৪০ হাজারেরও বেশি চাইনিজ সৈন্য পাকিস্তানের সীমানায় নিরাপত্তা প্রদান করে। এতে করে পাকিস্তান চায়নার একটি প্রত্যক্ষ শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত।

একবিংশ শতাব্দির ২য় দশক থেকে চলে আসা ‘আমেরিকা-চায়না ট্রেড ওয়ার’ অর্থাৎ বাণিজ্য যদ্ধ নতুন এক আগমনী যুদ্ধের মহাবিপদ সংকেত। তবে এ যুদ্ধটি হতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো কোনো মহাপ্রলয় অথবা কোল্ডওয়ার এর মতো নতুন এক ঠান্ডা যুদ্ধ। এরই মধ্যে, আমেরিকা চায়নার ‘হুয়াই’ ব্র‍্যান্ডের মোবাইলসহ বিভিন্ন পণ্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। সাথে সাথে চায়নাও আমেরিকার অনেক পণ্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আর এর মূল ভুক্তভোগীরা হলাম ‘আমরা’। তবে অস্ত্র দিয়ে হোক অথবা অর্থনীতি দিয়েই হোক, অন্য রাষ্ট্রের উপর নিজের কর্তৃত্ব খাটানোর মূলে রয়েছে ‘আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ’।

তবে এটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দু’ভাবেই হতে পারে। আধিপত্যবিস্তারে অন্য এক নব্য দাজ্জাল হলো ‘বিজেপি’ শাসিত ভারত। যদিও তারা এখনো বিশ্বরাজনীতিতে কাঁচা খেলোয়াড়। তবে আগামী বিশ্ব আধিপত্যবাদে আপাতত আমরা প্রধান দুই খেলোয়াড় হিসেবে আমেরিকা ও চায়নাকে ধরতে পারি। সাম্রাজ্যবাদ নতুন ইতিহাস তৈরি করতে এই দুই দেশের ডিপ্লোমেসি চোখে পড়ার মতো। তবে নতুন সাম্রাজবাদ নীতিতে আবারো ভেঙে পড়বে ডেভেলপিং কান্ট্রি তথা উন্নয়নশীল দেশগুলো। আফগানিস্থান, সিরিয়া, ইরাক, মিসর, সোমালিয়া, কাশ্মীর, মিয়ানমার ও ফিলিস্তিন চরমভাবে সাম্রাজ্যবাদের শিকার, যা কারো কাছে অজানা নয়। আবারো তৈরি হবে থার্ড ওয়ার্ল্ড। নতুন বিশ্ব রুপ নিবে নতুন সাম্রাজবাদে। ক্রমান্বয়ে মিডেল ক্লাস ধ্বংস হয়ে যাবে। টিকে থাকবে আধিপত্যবাদীদের পা চাটা গোলামগুলো।।।

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
217

Comment()

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *