উড়োজাহাজের একমাত্র যাত্রী রাফসান মাহমুদ !
আস্ত একটা উড়োজাহাজ ভাড়া (চার্টার্ড) করার কত খবরই তো পত্রিকায় পড়ি। ধনকুবেরদের ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ–বিলাসের গল্পও দৃষ্টি কাড়ে। অনেকের মতো আমার আগ্রহ ওই খবর পর্যন্তই। নিজে কখনো একা উড়োজাহাজে ভ্রমণ করব, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে সেটাই হয়ে গেল বাস্তবে। একজন সাধারণ যাত্রী হয়ে দেশের একটি বেসরকারি বিমান সংস্থার ফ্লাইটে উঠেছিলাম। গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর। যাত্রার ঠিক আগে জানতে পারি, কাকতালীয়ভাবে যাত্রী আমি একা!
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রার শেষ ধাপে আমাকে আটকাল ইমিগ্রেশন পুলিশ। একা যাওয়ার কথা শুনে চোখজোড়া তাঁদের রীতিমতো কপালে ওঠার জোগাড়। দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করলেন। তাঁদের অবাক করে দিয়ে আবার একই কথা বললাম, ‘সত্যিই বলছি, যাত্রী শুধুই আমিই। আমাকে একা নিয়ে যাচ্ছে।’
কথাটা বললাম বটে। কিন্তু তখনো আমার নিজের পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি যে উড়োজাহাজে আমি একাই যাচ্ছি। ইমিগ্রেশন কর্মীদের ভাবখানা দেখেও তা–ই মনে হলো, নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো খাতির চলে না! তাঁরা ফোন দিলেন সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজ সংস্থার অফিসে। ঘটনার সত্যতা জানলেন।
নিয়ম মেনে বোর্ডিং হয়ে গেল। ফটক পেরিয়ে দেখি গাড়ি অপেক্ষা করছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার গাড়ি। গাড়িতে উঠে দেখি, আমি একা। ‘একা যাচ্ছেন’ কথাটা তখন বিশ্বাস হতে শুরু করল। যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের শুরু সন্ধ্যায়, কাউন্টারে। সে সময় আমাকে অপেক্ষমাণ দেখে ফ্লাইটের একজন এসে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ উত্তরে গন্তব্যের কথা জানাতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি তো একাই যাচ্ছেন’।
টিকিট নিতে কাউন্টারে গিয়েও শুনেছি একই কথা। প্রতিবছর ঢাকা-কুয়ালালামপুর দুবার যাতায়াত করি। কোনো দিন তো এমন হয়নি। আর দূরের গন্তব্যে একজন যাত্রী নিয়ে উড্ডয়ন করবেই–বা কেন। কথাটা শুনে সন্দেহের দৃষ্টিতে বিদায় জানাতে আসা বন্ধুর দিকে তাকিয়েছিলাম।
গাড়িতে উঠে মনে হলো, ঘটনা তবে সত্যি! নিয়ম অনুযায়ী কেবিন ক্রুরা উড়োজাহাজের সিঁড়ির গোড়ায় স্বাগত জানালেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। বুকটা যেন ধক করে উঠল! বিশাল উড়োজাহাজের শতাধিক আসন রীতিমতো খাঁ খাঁ! আমার নির্ধারিত আসনে (এ-৭) বসলাম। মনে হলো, বিরল ঘটনার কথা বন্ধুদের জানাতে হয়! কিছু ছবি তুলে অনেককে মেসেঞ্জারে পাঠালাম।
বন্ধুদের সঙ্গে আলাপের সময় (রাত ৮টা ৫০ মিনিট) রানওয়েতে গতি বাড়ল উড়োজাহাজের। পুরো ফ্লাইটে চারজন কেবিন ক্রু ছাড়া যাত্রী শুধু আমি। নিয়ম মেনে তাঁরা সতর্কতা আর জরুরি বিষয় সম্পর্কে অবগত করল।
হুট করে একাকিত্ব জেঁকে বসল। উড়োজাহাজ তখন মাঝ আকাশে। পূর্ণগতিতে ছুটে চলছে গন্তব্যে। অনুভব করলাম হালকা শীত বোধ হচ্ছে। আমার কি জ্বর আসছে?
একাকী যাত্রার উচ্ছ্বাস দুশ্চিন্তা গ্রাস করল। তাপমাত্রা বাড়লে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে আটকে যেতে পারি। আটকে গেলে আবার ফেরত আসতে হবে দেশে। এমন ঘটনা তো কিছুদিন আগেও ঘটেছে। কেবিন ক্রু এসে জানতে চাইলেন, আমার কিছু চাই কি না। কফি চাইলাম। কফি পান করে একটু স্বস্তিবোধ করলাম। একবার মনে হলো, যাই একটু ককপিটে ঘুরে আসি। কিন্তু তাপমাত্রা বাড়ার শঙ্কায় পুরো পথে নিজের আসন ছাড়িনি।
যাত্রার আগে
আমার ফ্লাইটের সময় ছিল ১ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে। আগেভাগে বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির হই। যে বিমানবন্দর দিনমান মানুষে গমগম করত, সেটা প্রায় জনশূন্য। আমি এগিয়ে গেলাম ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কাউন্টারের দিকে। এই সংস্থা থেকেই আমার টিকিট নেওয়া। বিস্মিত হলাম কাছে গিয়ে। কাউন্টার বন্ধ। লোকজনও নেই। বাধ্য হয়ে ফোন করলাম গ্রাহকসেবার নম্বরে। সেখানে থেকে একজন পরামর্শ দিলেন উড়োজাহাজ সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য নির্ধারিত কাউন্টারে যোগাযোগ করতে। সেখানেই গেলাম। একজন আমার পাসপোর্টসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দেখলেন। সকাল ১০টায় সিদ্ধান্ত জানাবেন, বললেন।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। কারণ, আমার যাওয়ার কথা ছিল ১৫ আগস্ট। টিকিটও বুক করা ছিল। তখনো ফ্লাইট বাতিল হয়েছিল। সে সময় যাত্রার চার দিন আগেই জানিয়েছিল বাতিলের সংবাদ। আবার যাত্রার জন্য মালয়েশিয়া দূতাবাসকে জানাতে হয়েছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাতে হয়েছিল। চার ধাপে নতুন করে আবার কাগজ জোগাড় করতে হয়েছিল। কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে হয়েছিল। এই কাগজ সেই কাগজ জোগাড় করা বিরাট ঝক্কির কাজ। যাত্রা বাতিলের কথা ভেবেই শিউরে উঠছিলাম।
বিমানবন্দর থেকে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসি। ঢাকায় আমার বড় ভাইয়ের বাসা। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে ঢাকায় এসেছিলাম এসএসসির পর। ভাইয়ের বাসাতেই আমার কলেজজীবন কেটেছে। ২০০৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক শেষে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছিলাম। কিন্তু স্নাতক কোর্স শেষ করতে পারিনি। কয়েক বছর ব্যবসা করেছি। তারপর মনে হলো পড়াশোনা করতেই হবে। ২০১৬ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে গেলাম মালয়েশিয়ায়। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইউনিভার্সিটি কুয়ালালামপুরে অটোমোটিভ প্রকৌশলে শেষ বর্ষে পড়ছি।
৩ মার্চ দেশে এসেছিলাম। ফেরার কথা ছিল ১৭ মার্চ। টিকিট কাটাও হয়েছিল। কিন্তু ১৮ মার্চ থেকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হলো। ক্লাস অনলাইনে চলছিল কিন্তু আমার থিসিস বাকি ছিল। থিসিসের কাজ দেশে বসে করা যাচ্ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফেরার পরামর্শ দেয়। সেই পরামর্শেই যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করি।
কাটছে কোয়ারেন্টিনের দিন
সেদিন কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে নেমে রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত কেটেছিল। নিজেই বুঝতে পারছিলাম শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বেশি। বিমানবন্দরের মেডিকেল টিম এসে আমাকে নিয়ে গেল প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য। কোভিড-১৯ পরীক্ষার নেগেটিভ কাগজ হাতে ছিল, কিন্তু তারা আবার পরীক্ষার জন্য নমুনা নিল। তাপমাত্রা বেশি বলে চিকিৎসকের সন্দেহের দৃষ্টি। আধঘণ্টা কাটল চিকিৎসকের কক্ষে। রিপোর্ট এল। ‘নেগেটিভ’ শব্দটি দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। সেখান থেকে কর্তৃপক্ষ পৌঁছে দিল আবাসিক হোটেলে। ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষ হবে ১৫ সেপ্টেম্বর।
একাকী ঘরে বসে এখনো সেই একাকী যাত্রার কথা ভাবি।
লেখক: রাফসান মাহমুদ।
সূত্র: প্রথম আলো।