fbpx
হোম অন্যান্য ধ্বংস যুগের এই সময়ে ভবিষ্যতে গাছপালাগুলো যেমন হবে
ধ্বংস যুগের এই সময়ে ভবিষ্যতে গাছপালাগুলো যেমন হবে

ধ্বংস যুগের এই সময়ে ভবিষ্যতে গাছপালাগুলো যেমন হবে

0

সাড়ে চার’শ কোটি বছর আগে জন্ম নেওয়া পৃথিবী বৃহদাকারে এ পর্যন্ত পাঁচবার ধ্বংস হয়েছে। সর্বশেষ ধ্বংস হয়েছে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে, ডাইনোসর বিলুপ্তির সময়ে। এখন চলছে পৃথিবীর ষষ্ঠ ধ্বংসের যুগ।

নোবেল বিজয়ী পল ক্রুজেন এই ধ্বংস-যুগের নামকরণ করেছেন অ্যানথ্রোপোসিন (Anthropocene), যার অর্থ ‘মনুষ্য অধিযুগ।’ অনেক ভূতত্ত্ববিদ মনে করেন শিল্প বিপ্লবের পর থেকে জলবায়ু ও পরিবেশের ওপর মানুষের প্রভাব ও কর্তৃত্ব থেকেই এমন নামের উৎপত্তি।

২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১ হাজার কোটি, যা বর্তমানে ৮০০ কোটির কাছাকাছি রয়েছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দিতে অনেক বদলে যাবে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর প্রকৃতি ও উৎপাদন পদ্ধতি, বদলে যাবে উদ্যান ও কৃষিশিল্প, যা বিগত কয়েক হাজার বছরেও ঘটেনি। ধারণা করা হয়, পৃথিবী থেকে আলঙ্কারিক গাছপালা অনেক হ্রাস পাবে এবং সেসব গাছই প্রাধান্য পাবে, যাতে অলঙ্কার ও ফসল দুটোই পাওয়া যায়।

সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসে। প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া কখনো সুস্থ, সুন্দর জীবন যাপন করতে পারি না আমরা। এ বিষয়ে ১৯৮৪ সালে ‘বায়োফিলিয়া’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন এডওয়ার্ড উইলসন, যার অর্থ ‘জীবনের প্রতি ভালোবাসা’। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল থেকে এই বায়োফিলিয়া অনুভবের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনুমিত হয়।

আমরা যদি ভাবি, আগামী পৃথিবীর খাদ্যসংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা যান্ত্রিকভাবে কেবলই ফসলের চাষ করব, ফুল বা অন্যান্য বৃক্ষ-সৌন্দর্য আমাদের জীবন থেকে বিদায় নেবে, তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। দৈহিক ও মানসিক খাদ্য-উভয়ের মধ্যে সমঝোতা করতে গিয়ে উৎপত্তি হয়েছে ‘অর্নামেডিবল’ ধারণার, যাকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় ‘অর্নামেন্টাল ও এডিবল’। অর্থাৎ যা আলঙ্কারিক বিনোদন ও দৈহিক খাদ্য দুটোই সরবরাহ করবে। বায়োফিলিক মনোভাবসম্পন্ন মানুষের এসব অর্নামেডিবল উৎপন্ন হবে কোথায়, কীভাবে তা নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।

গৃহ নির্মাণের জন্য স্থানের অভাবের কারণে আমরা যেমন ক্রমেই বহুতল ভবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তেমনি শক্ত ইমারতে বহুতল কৃষি করারও প্রয়োজন দেখা দেবে একদিন। আমাদের দেশে এখন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ছাদ-কৃষি ও বারন্দা-কৃষির দিকে, যাকে বহুতল কৃষির ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যায়।

অনুন্নত প্রযুক্তির দেশগুলোতে খাদ্যাভাব প্রকট হচ্ছে দিন দিন। আগে সাধারণ পরিচর্যায় যে ফসল হতো তাতেই চলে যেত, এখন চলে না। বহিরঙ্গনে চাষাবাদ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে দূষণ ও বনায়নহীনতার ফলে আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠেছে। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিনির্ভর দেশ, আমাদের উপমহাদেশ। জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের নোনা জল উঠে আসছে ফসলি জমিতে, প্রচণ্ড খই-ফোটা তাপে পুড়ে যাচ্ছে শস্য, প্লাবনে-বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে ধানের শিষ, খরায় মাটি ফেটে চৌচির হয়ে পড়ছে।

যেভাবেই হোক, বৈরী প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের কমিয়ে ফেলতে হবে। উত্তর গোলার্ধের পশ্চিমা দেশগুলোতে তুষারপাত হচ্ছে, ঝোড়ো হাওয়া বইছে বাইরে। কিন্তু গ্রিনহাউসের ভেতরে উষ্ণ পরিবেশে দিব্যি বড় হচ্ছে টমেটো, শসা, বেগুন, বিভিন্ন রকমের সবজি। ফলনও হচ্ছে প্রচুর। স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে ঘেরা ঘর, সূর্যালোক ভেতরে আসছে, উত্তপ্ত হচ্ছে গ্রিনহাউসের ভেতরটা। কিন্তু সেই তাপ বেরিয়ে যেতে পারছে না। বিরুদ্ধ পরিবেশে মরুভূমিতেও হচ্ছে চাষাবাদ। বাইরে উড়ছে বালু, অসম্ভব তাপে যেকোনো সবজির গাছ পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কিন্তু ঘরের ভেতরের তাপ সহনীয় মাত্রায়। পলিথিন দিয়ে ঘেরা টানেলের মতো লম্বা গ্রিনহাউসের প্রান্তে আছে বড় বড় ফ্যান, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে ভেতরের তাপ। গাছের বৃদ্ধির জন্য রয়েছে পুষ্টি-জল, প্রয়োজনীয় জলীয়বাষ্প। ওপরে স্প্রিঙ্কলার থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর ঝরছে জল, নিচে গাছের গোড়াতেও রয়েছে জল সরবরাহকারী টিউব। ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে হালকা বাতাস। সেই বাতাসে শুকিয়ে যাচ্ছে অতিরিক্ত জল, ফাঙ্গাস ধরছে না। পরিবেশকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গ্রিনহাউসের আরেক নাম নিয়ন্ত্রিত কৃষি।

অত্যধিক দূষণপীড়িত চীনের নাগরিকদের প্রাকৃতিকভাবে বাসযোগ্য করার জন্য তৈরি হচ্ছে একটি মডেল নগরী, লিউচৌ-যার স্থপতি ইতালির স্তেফানো বোয়েরি। স্থপতি বোয়েরি প্রথম কৃতকার্য হন ইতালির মিলান শহরে ‘ভার্টিক্যাল ফরেস্ট’ ইমারত নির্মাণ করে, যা ‘ইন্টারন্যাশনাল হাইরাইজ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। গাছপালাসহ এর নির্মাণকাল ছিল ৫ বছর। চীনে ২০২০ সাল থেকে শুরু হয়েছে সাড়া জাগানো ‘লিউচৌ ফরেস্ট সিটি’র নির্মাণ, যাতে বাস করতে পারবেন ৩০ হাজার মানুষ। পৌনে দুই বর্গকিলোমিটারব্যাপী এই নগরীতে ১০ লাখ গাছের মধ্যে থাকবে ৪০ হাজার বৃক্ষ। এক বছরে এটি শোষণ করবে ১০ হাজার টন কার্বন ডাই–অক্সাইড, সরবরাহ করবে ৯০০ টন অক্সিজেন এবং শুষে নেবে ৫৭ টন দূষণ।

এই নগরীর ফ্ল্যাটগুলো থাকবে ধুলাবালুমুক্ত। ফ্ল্যাটের চারদিকে গাছপালা ফিল্টার করে নেবে রাস্তা থেকে উঠে আসা দূষণ, কমিয়ে দেবে পরিবেশের তাপমাত্রা। এসব গাছ শব্দ নিরোধক হিসেবেও কাজ করবে, ব্যস্ত নগরীর মধ্যে বাস করেও মনে হবে নিরিবিলি বনাঞ্চল। এসব ইমারতের জন্য যে এনার্জি দরকার হবে, সেগুলো আসবে ভূ-তাপ ও সৌরবিদ্যুৎ থেকে, যা কোনো দূষণ সৃষ্টি করবে না। চীন ছাড়া সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, মাদ্রিদ, আবুধাবি ও অন্যান্য দেশেও তৈরি হবে এমন ‘গ্রিন ফরেস্ট সিটি’ বা সবুজ বনের নগরী।

বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রাণীজ প্রোটিনের পরিবর্তে উদ্ভিদজাত প্রোটিন উৎপাদন করাই শ্রেয়। প্রাণীকে লালন-পালনের জন্য খামার তৈরি করতে হয়, তাতে অনেক বনাঞ্চল কাটা পড়ে। আবার গবাদিপশুর গোবর থেকে তৈরি হয় মিথেন। উষ্ণায়নের জন্য দায়ী মিথেন একটি গ্রিনহাউস গ্যাস, বাষ্প ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরই যার স্থান। এই গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রসঙ্গে আমাদের ধারণা হতে পারে, সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির জন্য একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। এতে বরং গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু প্রকৃতিতে এই বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হলে জলের অভাব দেখা দেবে। এই পরিবেশে গাছের উচ্চতা বেড়ে যাবে, পত্রাবলী বড় ও ঘনীভূত হতে থাকবে। ফলে বৃষ্টির পানি মাটিতে পৌঁছাবে কম, পাতা থেকেই অনেক জল উবে যাবে। উষ্ণ পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলে গাছের জীবনে ‘গ্রোয়িং সিজন’ বা বর্ধনকালও বেড়ে যাবে এবং সে কারণে গাছ মাটি থেকে অধিক পরিমাণে জল শোষণ করবে। গাছের আশপাশের জলাশয় নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং দেখা দেবে জলের ঘাটতি। বর্তমানে পৃথিবীর ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অন্তত ১ মাসের জন্য জলকষ্টে ভুগছে, ধনী দেশ আমেরিকার ডেট্রয়েটেও দেখা দিয়েছে এই সংকট।

জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদেরও পরিবর্তন হবে। যেসব গাছের ওপর আমরা একান্ত নির্ভরশীল, সেগুলো জন্মাতে হবে ভিন্নভাবে, ভিন্ন পরিবেশে। বাঙালির জীবনে যাবতীয় দানাশস্যের মধ্যে ধান ও গম খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিবেশে ধান কেমন জন্মাতে পারে, তা নিয়ে মিসিসিপি বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজা রেড্ডি এক সফল গবেষণা করেছেন।

তিনি গ্রিনহাউসে কৃত্রিমভাবে ভবিষ্যৎ কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিবেশ তৈরি করে তাতে রোপণ করেছেন ধান। গবেষণায় দেখা গেছে, ধানগাছের পাতা ঝাঁকালো হয়েছে, মাটির নিচের শিকড় বেড়েছে এবং বড় হয়েছে ধানের আকারও। এখন তাপ ও খরা সহ্য করতে পারে এমন হাইব্রিড ধান উদ্ভব করতে পারলেই পরিবেশের বৈরিতা থেকে মুক্তি পাব আমরা।

লেখক: কিউরেটর (টেক), সায়েন্স ওয়েসিস জাদুঘর, রিয়াদ, সৌদি আরব।

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *