ত্রাণের জন্য টাকা নিলেন ইউএনও, কিন্তু ত্রাণ পাননি কেউই
করোনা দুর্যোগে শিল্পাঞ্চল সাভার ও আশুলিয়ার প্রায় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকের একটা বড় অংশ এই অঞ্চলের ভোটার না হওয়ার কারণে তাদের কপালে জুটছে না সরকারি ত্রাণ।
বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত। তাই সাভার ও আশুলিয়া এলাকার ইউপি সদস্য থেকে চেয়ারম্যান ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও অসহায়দের ভাগ্যে জুটছে না সামান্যতম খাদ্য সহায়তা।
অন্যদিকে করোনায় সহযোগিতার জন্য ফান্ডের কথা বলে একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে আদায় করার অভিযোগ রয়েছে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাভার ও আশুলিয়ার জন্য সরকারিভাবে (জি আর এর) ১০০ টন চাউল এবং শিশু খাদ্যসহ নগদ ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে এই এলাকা শিল্পাঞ্চল জোনের কারণে দেশের যে কোনো জেলার জনসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ এখানে বসবাস করছেন। জনসংখ্যার তুলনায় এই বরাদ্দ খুবই সামান্য বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ফলে তাদের স্থানীয় ভোটারদের ত্রাণ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সাভার উপজেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি বরাদ্দ পাওয়া চাউল শেষ হয়েছে বহু আগেই। অন্যদিকে জনসংখ্যার পরিমাণ বেশি হওয়ায় অনেক চেয়ারম্যান ব্যক্তিগত উদ্দোগে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজুর রহমানের গঠিত করোনা ফান্ডে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন চেয়ারম্যানেরা।
অভিযোগ রয়েছে অনুদানের টাকা উত্তোলনের পর থেকে অদ্যাবধি উপজেলার কোথাও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়নি ওই কর্মকর্তাকে। সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনি মহল্লার কাসেম ভিলা নামক একটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। সেখানে বসবাস করেন অন্তত ১০ থেকে ১৫টি পরিবার। তাদের অভিযোগ ফেসবুকে উপজেলা প্রশাসনের হট লাইন নাম্বারে খাদ্য সহায়তার জন্য তিন দিন যোগাযোগ করেও ত্রাণ মেলেনি। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন নম্বরটিতে একাধিক বার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
এছাড়া সাভারের অধিকাংশ মহল্লার চিত্র প্রায় একই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিবরা বলেন, উপজেলার জন্য বরাদ্দকৃত ১০০ টন চাউলের মধ্যে ১২টি ইউনিয়নে তাদের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ টন চাউল বিতরণ করা হয়েছে। বাকি খবর তারা জানেন না। এছাড়া চাউলের পাশাপাশি নগদ ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হলেও তা চেয়ারম্যানদেরকে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ত্রাণের চাউলের সাথে ১ কেজি ডাল, আলু, পেয়াজ, তেল ব্যক্তিগত অর্থ থেকে ক্রয় করে বিতরণ করছেন ইউপি চেয়ারম্যানেরা।
তবে নির্বাহী কর্মকর্তাকে তারা যে টাকা দিয়েছেন সেখান থেকেও কোন সহযোগিতা পায়নি তারা। মোবাইল ফোনে না পেয়ে উপজেলা বাসভবনে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকরা। সেখানে সকলকে ত্রাণ নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আ: মজিদ সরদার অভিযোগ করে বলেন, কারখানার শ্রমিকরা এই অঞ্চলের ভোটার না হওয়ার কারণে তাদেরকে কেউ ত্রাণ সহযোগিতা দিতে চাচ্ছে না। অনেক কারখানার শ্রমিক বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তিনি এই শ্রমিকদের সহায়তার জন্য স্থানীয় মেম্বার থেকে চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েও কোন খাদ্য সহযোগিতা পাননি। এমনকি সর্বশেষ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজুর রহমানের বাসভবনে গিয়েও খালি হাতে ফিরে আসেন। এখানে কোন সহযোগিতা দেওয়া হয় না বলে জানিয়ে দেয় ওই কর্মকর্তা।
অভিযোগ করে মহল্লার বিভিন্ন দিন মজুর শ্রমিকেরা বলেন, তারা কাজের সুবাদে সাভারের এলাকায় বসবাস করেন। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর, মেম্বার, চেয়ারম্যানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন সহযোগিতা পায়নি। তারা এই এলাকার ভোটার না হওয়ার কারণে কেউ তাদের ত্রাণ দেয়নি বলেও অভিযোগ করেন।
বনগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল, তিনি নির্বাহী কর্মকর্তাকে চাহিদা অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছেন। তবে তাদের দেওয়া টাকা দিয়ে নির্বাহী কর্মকর্তা কোথায় বা কাদের সহযোগিতা করবে এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে এই টাকা ব্যাংকে না নিয়ে নগদ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে যে পরিমাণ চাল পেয়েছেন তা দিয়ে স্থানীয় ভোটারদেরই ঠিক মতো খাদ্যসামগ্রী দিতে পারেনি।
অন্যদিকে উপজেলা থেকে শুধু মাত্র চাল দেওয়া হয়েছে। তিনি কোন নগদ টাকা সহযোগিতা পাননি। এদিকে শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরুজ বলেন, করোনায় খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করার কথা বলে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাদের প্রত্যেক চেয়ারম্যানকে নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য এক মিটিংয়ে নির্দেশ দেয়। তিনি নির্বাহী কর্মকর্তার চাহিদা মোতাবেক নগদ ৫০ হাজার টাকা তার কাছে দিয়ে এসেছেন। এছাড়াও ধামসোনার চেয়ারম্যান ও আশুলিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ১ লাখ টাকা করে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। তবে তিনি কোন নগদ টাকা অনুদান পাননি বলে জানান।
একই কথা বলেছেন, ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার। তবে তিনি লকডাউনের কারণে নির্বাহী কর্মকর্তাকে টাকা পৌঁছিয়ে দিতে পারেননি। তিনি বলেন, আগামী দু-একদিনের মধ্যে তিনি টাকা পৌঁছে দেবেন। এছাড়া আশুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহাবউদ্দিন বলেন, কেউ ৫০ হাজার আবার অনেকেই এর বেশিও টাকা দিয়েছেন। তবে পাথালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পারভেজ দেওয়ান বলেন, ত্রাণের চাল পেলেও অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী কেনার জন্য কোন আর্থিক সহযোগিতা বা নগদ টাকা এখনো পাইনি।
করোনা ফান্ডে টাকা অনুদান দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমার কাছেও টাকা চাওয়া হয়েছিলো কিন্তু আমি কোন টাকা দেইনি। উত্তোলন করা টাকা নির্বাহী কর্মকর্তা কোথায় বা কোন জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন এমন তথ্য সাভার পৌর, থানা ও আশুলিয়া থানা এলাকার বিভিন্ন মহল্লায় খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায়নি।
তবে ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে করোনায় সহযোগিতার জন্য টাকা আদায়ের কথা জানতে যোগাযোগ করা হলে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে এবং হবে। ত্রাণ নিয়ে কোন লুকোচুরি করা হচ্ছে না। অন্যদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এসব অনিয়মের বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌসের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভি করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।