ডক্টর মো. সামসুজ্জামান
মানুষ এক সময় প্রকৃতির রাজ্যে অসহায় অবস্থায় বাসবাস করত। পরবর্তীতে মানুষ তার মেধা, যোগ্যতা ও পরিশ্রম দ্বারা ধীরে ধীরে নিজেদের মতো করে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে থাকে। শত শত বছরের পরিশ্রম ও সাধনা দ্বারা মানুষ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠন করে নিজেদের অসহায় অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চলাতে থাকে। কৃষি, শিল্প, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব থেকে অনেকটাই নিজেদের সুরক্ষিত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে মানুষ বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার শীর্ষে অবস্থান করা সত্ত্বেও প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ কখনও কখনও যে কতটা অসহায় তা বিভিন্ন সময় মহামারি এসে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগে বসবাস করেও মানুষের অসহায়ত্ব আবারও নতুন করে মনে করিয়ে দিলো করোনাভাইরাস।
মহামারির বিষয়টি পৃথিবীতে নতুন নয়। হাজার হাজার বছর আগেও মহামারির অস্তিত্ব ছিল। তবে বিগত কয়েক শ বছরের মহামারির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় খুব অদ্ভুতাবে প্রতি ১০০ বছর পর পর মহামারি এই পৃথিবীতে হানা দিচ্ছে। ১৩২০ সালের বুবোনিক প্লেগ মহামারিতে পৃথিবীর প্রায় ২০ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৪২০ সালের দ্বিতীয় প্লেগ- প্রলয় নামে শুরু হয়ে পরবর্তীতে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৫২০ সালের দিকে স্প্যানিস বণিকদের মাধ্যমে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের মধ্যে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মারা যায় প্রায় ১ লাখ মানুষ। একই সময়ে মেক্সিকোসহ সারা বিশ্বে গুটি বসন্ত, প্লেগ ও হাম মহামারি আকারে দেখা দেয়। ১৬২০ সালে আরেক মহামারি দেখা দেয় যার নাম Ôমে ফ্লাওয়ার’। এই সময়ের অজানা রোগে স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাসসহ ভাইরাস জ্বরে লন্ডন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। এর ১০ বছর পর ইতালিতে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ রোগে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়। ১৭২০ সালে প্লেগ অব মার্শেই মানব জাতির উপর হামলে পড়ে। শুধু ফ্রান্সেই মারা যায় ১০ লাখ মানুষ। ১৮২০ সালে ভারতবর্ষে কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে, মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। ১৯২০ সালে আসে দ্যা স্প্যানিস ফ্লু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে রোগটি দ্রুত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মারা যায় প্রায় ১০ কোটি মানুষ। সবশেষে ২০১৯ সালের শেষে বা ২০২০ সালে এসে দেখা দিল করোনা মহামারি।
করোনাভাইরাস নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা ও গুজব চলছে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক এক কর্মকর্তার মতে, চীনের উহানের সামরিক গবেষণাগারে করোনার জন্ম এবং সেখান থেকেই করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও মনে করেন চীনই এই ভাইরাস গবেষণাগারে তৈরি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বে চীনের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। অন্যদিকে চীন ও ইরান মনে করে যুক্তরাষ্ট্রই এই জীবাণু অস্ত্র প্রয়োগে করেছে চীনের উপর এবং সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত দ্যা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন- এ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনজন বিখ্যাত গবেষকের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয় এই ভাইরাস চীনের উহানের স্থানীয় একটি পশুর মার্কেট থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত এটিই প্রমাণিত।
করোনাভাইরাস বিশ্বের ২০০ এর অধিক দেশে সংক্রমিত হয়েছে। অতীতে কোন মহামারি এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে মানুষ খুব দ্রুত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতে পারে ফলে করোনাভাইরাসও ছড়িয়েছে খুব দ্রুত। বিশ্বের ২০০ এর অধিক দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে সমগ্র পৃথিবীতে এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্যকমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০ নভেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ৫ কোটি ৬৭ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ এবং এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ। করোনায় সারা বিশ্বের অর্থনীতি যে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। অর্থনীতির বাইরে বিশ্ব রাজনীতিতেও করোনার প্রভাব পড়েছে। জার্মান অর্থমন্ত্রী টমাস শাফে করোনা বিপর্যয়ের ভয়াবহতার চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড ফিলিপ্পে করোনার প্রভাবে পদত্যাগে বাধ্য হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে পরাজয়ে করোনার প্রভাব বিদ্যমান। তবে করোনার চাপ সামলে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও বেগবান হয়েছে।
৮ মার্চ, ২০২০ বাংলাদেশে প্রথম ৩ জন করোনা রোগী পাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় যাদের দুজন ছিলেন ইতালি ফেরত। ততোদিনে চীন থেকে ইতালিতে ভালোভাবেই করোনা ছড়িয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত ছিল চীনে এবং ইতালিতে। প্রচুর বাংলাদেশী প্রবাসী ছিল। এজন্য বাংলাদেশে করোনার ঝুঁকি ছিল অত্যধিক। যদিও সরকার করোনার বিষয়ে সচেতন ছিল, তদুপরি করোনা প্রতিরোধের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে করোনা সারা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে পড়ে। নভেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে ৬ হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পরে উন্নত দেশের পথে যাত্রা শুরু করেছিল ঠিক তখনই করোনার আঘাতে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সাময়িকভাবে থমকে যায়।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে করোনা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ যে ধরনের প্রভাব ফেলছে বা ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা হচ্ছে বাংলাদেশে ১ বছরে প্রায় ৯ লাখ কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে এডিবির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জিডিপির ক্ষেত্রে সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। মোটা দাগে পাঁচটি খাতে বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে:
- সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা খাতে। এই খাতে ১১৪ কোটি ডলারের ক্ষতি হতে পারে।
- কৃষিখাতে ৬৩ কোটি ডলারের ক্ষতি হতে পারে।
- হোটেল রেস্তোরা ও এ ধরনের সেবাখাতে প্রায় ৫১ কোটি ডলারের ক্ষতি হতে পারে।
- উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রায় ৪০ কোটি ডলার এবং পরিবহন খাতে সাড়ে ৩৩ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে। সবমিলিয়ে ১ বছরে প্রায় ৩০২ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে বলে আশংকা করছে এডিবি।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের নেয়া চারটি কৌশলগত কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত তিন ধাপে কার্যকর করা হবে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য সরকার গৃহীত চারটি কর্মসূচি হলো :
- সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা,
- আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন,
- সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি
- এবং মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ এপ্রিল, ২০২০ করোনার ক্ষতি কাটাতে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যা জিডিপির ৩.৩ শতাংশ। পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে যার মোট পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ যা ১২ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।’ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে দেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এ পর্যন্ত যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে :
বরাদ্দকৃত খাতের নাম
|
বরাদ্দকৃত টাকার পরিমাণ
|
ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাত | ৩০ হাজার কোটি টাকা |
ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প | ২০ হাজার কোটি টাকা |
রফতানিমুখী শিল্প | ৫ হাজার কোটি টাকা |
ব্যাংক রফতানি উন্নয়ন তহবিল | ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা |
প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট প্রকল্প | ৫ হাজার কোটি টাকা |
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের | ১০০ কোটি টাকার বিশেষ সম্মাননা, |
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের | ৭৫০ কোটি টাকার স্বাস্থ্য বীমা ও জীবন বীমা |
বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ | ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা |
কৃষি ভর্তুকি | ৫ হাজার কোটি টাকার |
কৃষি পুনঃতফসিলকরণ প্রকল্প, স্বল্প আয়ের পেশাদার কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য | ৩ হাজার কোটি টাকা |
প্রতি কেজি ১০ টাকায় চাল বিক্রি | ২৫১ কোটি টাকা |
লক্ষ্যভিত্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে নগদ বিতরণ | ১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। |
ভাতা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো | ৮১৫ কোটি টাকা |
গৃহহীন মানুষের জন্য | ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা |
বাড়িঘর করতে, বোরো ধান/ধান ক্রয় কার্যক্রম (অতিরিক্ত ২ লাখ টন) | ৮৬০ কোটি টাকা |
কৃষিকাজের যান্ত্রিকীকরণের জন্য | ২০০ কোটি টাকা |
বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের জন্য | ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা নগদ অর্থ বিতরণ । |
কোন সহায়তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া কর্মহীন ৫০ লাখ পরিবারের জন্য মোট দেওয়া হয়েছে, যা প্রতিটি পরিবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে পেয়েছে। | ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা |
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দুই দফায় | ১৭ কোটি টাকারও বেশি |
মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন | ১২২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা |
কর্মহীন যুবক ও প্রবাসীদের সহায়তার জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন | ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত মূলধন |
কৃষকদের ভর্তুকি মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টর এবং রিপারস্ যন্ত্র সরবরাহ | ২০০ কোটি টাকা |
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক ঋণ গ্রহীতাদের সহায়তার জন্য
|
১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার ব্যাংক সুদ মওকুফ |
এ প্রণোদনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য প্রদত্তপ্রণোদনা সমূহ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং সংকটকালীন সময়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সমূহ বিশেষত্ শিল্পোন্নত দেশ সমূহ যেখানে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাকাকে সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফল্যের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাকাকে শুধু সচল রাখেননি সামনের দিকেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ইতিবাচক বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাপারে আশাব্যঞ্জক মতামত দিয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তাই চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে এই দাতা সংস্থাটি। এডিবি বলছে, বাংলাদেশ ৩০ দেশের মধ্যে ২৬তম। আগামী বছরের শুরুতে অর্থনীতি আরও বেগবান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে সংস্থাটি। আরেক দফা এগিয়ে করোনার মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি দেশজ (জিডিপি) উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হবে বাংলাদেশ।
করোনার কারণে রেমিটেন্স আসা কমে গেলেও অবিশ্বাস্যভাবে জুন, ২০২০ এ রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে, যার ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
কৃষিখাতের গুরুত্ব কতখানি তা করোনা এসে আবার ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। আশার বিষয় হলো বাংলাদেশ সরকার কৃষিখাতের প্রতি বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। এ খাতে সরকারের কৃষিনীতি এবং ভর্তুকি প্রদানের ফলে করোনাকালীন সময়েও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের এক বড় অংশ গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রামীণ অবকাঠামো ও অর্থনীতির প্রতি গুরুত্ব বাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে এটিও করোনার একটি ভালো দিক হতে পারে।
কৃষিখাতের গুরুত্ব কতখানি তা করোনা এসে আবার ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। আশার বিষয় হলো বাংলাদেশ সরকার কৃষিখাতের প্রতি বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। এ খাতে সরকারের কৃষিনীতি এবং ভর্তুকি প্রদানের ফলে করোনাকালীন সময়েও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের এক বড় অংশ গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রামীণ অবকাঠামো ও অর্থনীতির প্রতি গুরুত্ব বাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে এটিও করোনার একটি ভালো দিক হতে পারে।
বাংলাদেশে করোনার সামাজিক প্রভাব
করোনার কারণে বাংলাদেশে সামাজিকভাবে প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ দেশের মানুষের আতিথেয়তা, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের যে সংস্কৃতি শত বছর ধরে চলে আসছে তা করোনার কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন।
করোনায় বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব : বাংলাদেশে করোনার শুরুর দিকটা ছিল অনেকটা হানিমুন পর্বের মতো। করোনায় লকডাউনের শুরুতে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ বেশ আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে বাসায় সময় কাটাতে থাকে। কিন্তু করোনায় সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ও লকডাউন দীর্ঘ হওয়ার সাথে সাথে বাঙালির হানিমুন পর্বও শেষ হয়ে যায়। করোনার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে সবাই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। আতংকিত অবস্থা শুরু হয়ে গেলে আমাদের মূল চরিত্র অর্থাৎ ভয়ংকর স্বার্থপরতার চিত্র প্রকাশ পেতে থাকে।
ক) কোন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে এমন দৃষ্টিতে দেখা শুরু হলো যেন সে সমাজের ভয়ংকর কোন পাপী ব্যক্তি অথচ করোনায় আক্রান্ত হওয়া কোন অপরাধ নয়।
খ) করোনা আক্রান্ত হলে ডাক্তার দেখানোর জন্য আমরা পাগল হয়ে গেলাম কিন্তু কোন ডাক্তার, নার্স করোনা আক্রান্ত হলে তার বাড়িতে ঢিল ছুড়ে এলাকা ছাড়া করতে চাইলাম। এর মাধ্যমে আমাদের স্বার্থপরতার চিত্র পরিষ্কার হয়ে গেল।
গ) আমাদের স্বার্থপরতা এতটাই হিংস্র পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য হাসপাতাল স্থাপনে বাধা দিলাম। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আত্মীয়স্বজন দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা তাকে দাফন করতেও বাধা দিলাম।
ঘ) করোনার ভয়ংকর বিপদের মধ্যেও শাহেদ, সাবরিনাদের মতো অমানুষেরা জাতির সাথে প্রতারণা করলো।
ঙ) সামর্থ্যবানদের উপর নির্ভরশীল যে সব নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ ছিল তাদের আমরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলাম। তারা কিভাবে সংসার চালাবে, কিভাবে বেঁচে থাকবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করলাম না।
ছ) করোনার কারণে চাকুরি বা কর্ম হারিয়ে বহু মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক নানা কলহ সৃষ্টি হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে করোনাকালীন সময়ে পারিবারিক কলহ ও বিচ্ছেদ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
তবে এর বিপরীত চিত্র আমরা পাশাপাশি দেখতে পেয়েছি এজন্য কৃতিত্বের দাবিদার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সরকারের ব্যাপক জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রম ও প্রচারণা।
করোনায় বাংলাদেশে সামাজিকক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব বেশি হলেও কিছু ভালো দিকও আছে। করোনাকালীন সময়ের শুরুতে বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিল সেক্ষেত্রে অনেকের পারিবারিক বন্ধন মজবুত হয়েছে। যে সমস্ত বাবা-মায়েরা প্রচুর ব্যস্ত থাকতেন, করোনার মধ্যে তারা বাসায় সময় দিতে পেরেছেন। তাতে সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে হৃদ্যতা বেড়েছে। যারা ব্যস্ততার অজুহাতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন না, এই সুযোগে অনেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করেছেন যা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক।। করোনাকালীন সময়ে রোগীদের চিকিৎসায় কিছু মানুষ নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ প্রশাসন, কিছু সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য যারা নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেও মানবসেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের দাফনের জন্য যখন কোন আত্মীয়-স্বজন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সেই মুহূর্তে কিছু পরোপকারী ব্যক্তি ও সংগঠন সাহসের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে আসে এবং প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ সবাই স্বার্থপর নয়, জাতি হিসেবে আমরা এখনও সাহসী, সংগঠিত এবং মানবতাবাদী।
শিক্ষাক্ষেত্রে করোনার প্রভাব
বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে করোনার প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের সকল সেক্টর মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও দীর্ঘ আট মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া থেকে একেবারে দূরে সরে গেছে বলা যায়। যদিও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনলাইন ভিত্তিক কিছু শিক্ষাকার্যক্রম চলছে, আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার খুব বেশি প্রভাব পড়ছে না। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। এ অবস্থা আরও বেশ কয়েকমাস স্থায়ী হলে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। আবার করোনাকালীন সময়ে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা যেভাবে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে তা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তারা শারীরিক, মানসিক ও নৈতিকতায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অপরদিকে, করোনাকালীন সময়ে স্বল্প পরিসরে হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে যে অনলাইন কার্যক্রম শুরু হয়েছে তা বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের পথকে তরান্বিত করবে।
আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, করোনার কারণে বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ কর্ম হারিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে যা দূর করতে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারলে সামগ্রিকভাবে আমাদের পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থায় বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। আর্থিকভাবে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো করোনায় যেভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে সেই তুলনায় বাংলাদেশে করোনা মহামারির ভয়াবহতা বেশ কম। করোনা মোকাবেলায় আর্থিক ও অন্যান্য সক্ষমতা কম থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে করোনার ক্ষতিকর প্রভাব যতটা কমিয়ে আনা যায়। সামগ্রিকভাবে আমাদের মতো একটি দেশে করোনার যে প্রভাব পড়েছে তার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা চালাতে হবে।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নৈতিকতার চর্চা করতে ব্যর্থ হচ্ছি যা করোনাকালীন সময়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। যদি আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা অনৈতিকতার চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি তাহলে আমরা সাফল্যের সাথে এ সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো। কারণ আমাদের দেশ ও জাতির নেতৃত্বে আছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক