fbpx
হোম অন্যান্য ২০০ বছরেও মণ্ডা তৈরির ফর্মুলা ফাঁস করেনি বাংলাদেশের যে পরিবার !
২০০ বছরেও মণ্ডা তৈরির ফর্মুলা ফাঁস করেনি বাংলাদেশের যে পরিবার !

২০০ বছরেও মণ্ডা তৈরির ফর্মুলা ফাঁস করেনি বাংলাদেশের যে পরিবার !

0

প্রায় ২০০ বছর ধরে এক পরিবারেই লুকিয়ে রয়েছে রহস্য। মণ্ডা তৈরির রহস্য, জানে না অন্য কেউ। শুধু বাংলাদেশের এক পরিবারই যুগ যুগ ধরে তৈরি করে আসছে বিখ্যাত এই মণ্ডা। ওই পরিবার ছাড়া অন্য কেউ মণ্ডার রহস্য জানেন না বলে দাবি মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানের মালিকপক্ষের।

ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে মুক্তাগাছা উপজেলা। এখানকার পৌর শহরে অবস্থিত প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গোপাল চন্দ্র পালের মণ্ডার দোকান। ১৮২৪ সালে গোপাল পাল এক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে এই মণ্ডা তৈরির ফর্মূলা পেয়েছিলেন বলে কথিত আছে। পরবর্তী সময়ে বংশপরম্পরায় তার উত্তরসূরিরা মণ্ডা তৈরি করে আসছেন। মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীও গোপাল পালের মণ্ডার প্রশংসা করেছিলেন। গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর প্রয়াত রমেন্দ্র নাথ পাল মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডা নিয়ে তাদের প্রকাশিত এক আলেখ্যে মণ্ডার বর্ণনায় বলেছেন, মণ্ডা মিঠাই, মিষ্টান্ন, মিষ্টি যে নামেই বলি তা শুধু খাদ্যদ্রব্য হিসেবেই নয় বরং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হিসেবেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে দুই পালায় তৈরি করা হয় এই মণ্ডা। রবীন্দ্রনাথ পাল জানান, প্রতিদিন প্রায় ৫০ কেজির মতো মণ্ডা তৈরি করা হয়। প্রতি পিস মণ্ডার দাম ২৫ টাকা। আর প্রতি কেজি মণ্ডা বিক্রি হয় ৫০০ টাকায়। এক কেজিতে গড়ে ২০ পিস মণ্ডা থাকে।

অতীতে জমিদারবাড়ির খাবারের তালিকায় জায়গা করে নেয় মণ্ডা। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে উপহার হিসেবে পাঠাতে মণ্ডাকেই বেছে নেন জমিদারেরা। জমিদার পরিবারটির মাধ্যমেই মণ্ডার দেশব্যাপী সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা যায়।

গোপাল পাল মারা যান ১৯০৭ সালে। এরপর পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে এ মণ্ডা তৈরি করেন গোপাল পালের বংশধরেরা। এখন পর্যন্ত গোপাল পালের উত্তরসূরিরাই কেবল এই মণ্ডা তৈরি করে থাকেন। মণ্ডার ইতিহাস নিয়ে গোপাল পালের বংশধরদের বের করা পুস্তিকায় বলা হয়েছে, মণ্ডা এক প্রকারের সন্দেশ। শুধু ছানা ও চিনি দিয়ে এটি বানানো হয়। তবে স্বাদের রহস্যটা পাকের (রান্নার) মধ্যে লুকিয়ে আছে, যা বছরের পর বছর ধরে গোপন রাখা হয়েছে।

ওই মণ্ডা তৈরির কৌশল নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যেও রয়েছে অপার কৌতূহল। এটি কয়েকটি খুবই সাধারণ উপাদানে তৈরি করা হয়। সেখানে মূল উপাদান হিসেবে ঘন দুধের ছানা এবং গুড় বা চিনি দিয়ে তা প্রস্তুত করা হয়। আর বাকিটা হলো কারিগরের হাতের কৌশল ও অভিজ্ঞতা। মণ্ডার দোকানের মালিকেরা নিজেদের দোকানের কর্মচারীদেরও মণ্ডা তৈরির স্থানে যেতে দেন না। কেবল রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তির নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েকবার এর ব্যত্যয় ঘটেছে।

সময়ের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ মণ্ডার ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। এতদিন পরেও এ মণ্ডার গুণগতমান ঠিক রাখা সত্যিই একটি আশ্চর্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটি হওয়ার কারণ সম্ভবত শুধু একটি জায়গায় বংশপরম্পরায় মানসম্পন্নভাবে এ মণ্ডা তৈরি করা। এ মণ্ডা বাংলাদেশের শুধু মুক্তাগাছাতেই হয়। সেখানে তাদের দোকানের নোটিশ বোর্ডেই লেখা রয়েছে যে, সারা দেশে তাদের আর কোনো শাখা বা শোরুম নেই। এই মণ্ডার প্যাটেন্ট বা রেসিপি অত্যন্ত গোপনীয় এবং তাই এটা আর কাউকেই দেওয়া হয় না।

এক হাতে এবং একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে তৈরি করা হয় বিধায় প্রতিটি মণ্ডাই আকার-আকৃতি ও ওজনে সমান হয়ে থাকে। সে জন্য দেখা গেছে প্রতি কেজিতে ২২টি মণ্ডা ধরে। আর প্রতি পিস যত টাকা মূল্য ধরা হয়, ২২টি হিসাবে তার কেজির মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। দামও নাগালের ভেতরে, যা কোনো রকম দামাদামি ছাড়াই একদামে বিক্রি করা হয়। সেখানে গেলে মণ্ডা তাদের দোকানে বসে খাওয়া যায় আবার যত খুশি কিনে নিয়েও আসা যায়।

মণ্ডার দোকানটির মালিকদের একজন বলেন, বিভিন্ন সময় দোকানে বসেই এই মণ্ডার স্বাদ নিয়েছেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানসহ অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিকদের পাশাপাশি চলচ্চিত্র জগতের রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, কবরী, শাবানা, ববিতাসহ আরও অনেকে এই দোকানে বসে মণ্ডা খেয়ে সুনাম করেছেন।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে গেলে এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাদের তৈরি মণ্ডার স্বাদ নিতে চান। গত বছর একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য মণ্ডা বানানো হয়। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার সামনেই তাদের মণ্ডা বানাতে হয়েছিল। নিরাপত্তার কারণে এরকম আরও কয়েকবার মণ্ডার গোপনীয়তার ফাঁস হয়েছে।

মুক্তাগাছার মণ্ডার দোকানের বর্তমান পাঁচজন মালিকের একজন শিশির পাল। তিনি জানান, তাদের পাঁচ ভাই বর্তমান মালিক। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। তারা আধুনিক শিক্ষা নিয়েও বংশানুক্রমে মণ্ডার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। তবে এরপরের প্রজন্মের সদস্যদের আর মণ্ডার ব্যবসায় আগ্রহ নেই। এর মধ্যেই কেউ পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক বা ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে দিয়েছেন।

মণ্ডার কৌশল গোপন রাখার ফলে ঐতিহ্যবাহী এ সুস্বাদু খাবার হারিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা মুক্তাগাছার অনেক মানুষের। সে প্রসঙ্গে শিশির পাল বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যেও কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। যে কারণে সারা দেশেই মুক্তাগাছার মণ্ডার দোকানের শাখা করার কথা ভাবছেন তারা। মুক্তাগাছার এ মণ্ডা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব জায়গায় যে কোনো আচার অনুষ্ঠানের জন্য খুবই কদর ও গুরুত্বপূর্ণ। এসব এলাকায় বিয়ে, জন্মদিন, পূজা-পার্বণ ইত্যাদিতে অতিথি আপ্যায়নে সবার পছন্দের এ মণ্ডা ছাড়া যেন চলেই না। দেশি-বিদেশি যার যার অফিসের বড় কর্তাকে খুশিতে চমকে দিতে মণ্ডার জুড়ি নেই।

দেশ-বিদেশের কেউ ময়মনসিংহ অঞ্চলে ভ্রমণে এলে মুক্তাগাছার এ মণ্ডার তুলনা নেই। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে পশ্চিম দিকে ১৬ কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে দেশের সেই একমাত্র মণ্ডার দোকানটি। এ এলাকায় ভ্রমণ করতে আসা সবার পছন্দের আইটেম হলো মণ্ডা, কাজেই মুক্তাগাছা নামটির সঙ্গে মণ্ডা নামটি যেন একটি ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় সবার খেয়াল রাখতে হবে যে, মুক্তাগাছার মণ্ডা বলে দেশের অন্য কোথায় বিক্রি করলে সেটা অবশ্যই মুক্তাগাছার মণ্ডা নয়।কাজেই মুক্তাগাছার মণ্ডা যিনি এখনো খাননি, তাঁরা যে কোনো উপায়েই হোক একবার অন্তত খেয়ে নেবেন। কারণ এটি সত্যিই অসাধারণ। না খেলে সারা জীবনের জন্য এটি একটি বড় আফসোসের বিষয় হয়ে থাকবে।

এখন অনেকেই মণ্ডার জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিফিকেশন) স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি তুলেছেন। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, ২০১৭ সালেই সে দেশের ব্যবসায়ী মহল থেকে মণ্ডার জিআই স্বীকৃতি নেয়ার দাবি উঠেছে।

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

LEAVE YOUR COMMENT

Your email address will not be published. Required fields are marked *